পাকীজা মঞ্জরী চৌধুরী
আধুনিক ভারতের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়ের আবির্ভাব পরাধীন ভারতে পরম আশীর্বাদের মত। তিনি সে সময়ে না জন্মালে আমরা আজ কয়েকদশক পিছিয়ে থাকতাম—মননে, চিন্তনে ও ব্যবহারিক বিধিবিধানে। তিনিই ছিলেন উনিশ শতকের নবজাগরণের অগ্রদূত। শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, সাহিত্য—এমন কোন বিষয় নেই, যেখানে তিনি বিপ্লব ঘটান নি। আজকের বাংলা সংবাদপত্রও সেই উনিশ শতকের নবজাগরণের অংশ।
ভারতীয় সাংবাদিকতার আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত হয় ১৭৮০ সালে প্রকাশিত ইংরেজি ভাষার প্রথম সংবাদ পত্র বেঙ্গল গেজেট (‘A weekly political and commercial paper open to all parties, but influenced by none’) এর হাত ধরে। এই গেজেট রামমোহনের সাংবাদিকতার ও স্বাধীনতার ধারণাকে পরিপুষ্ট করতে সাহায্য করেছিল। পরে ১৮১৮ সালে প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র বাকিংহাম সম্পাদিত ক্যালকাটা জার্নাল প্রকাশিত হলে রামমোহন সেখানে সহমরণ প্রথার বর্বরতার বিরুদ্ধে লেখালেখি করেন। বাকিংহাম একজন উদারনৈতিক ইংরেজ সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে বাংলার সমাজ-সংস্কারকদের প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল। ‘সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ এই পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানা যায়। সেই সময়ে আরও কয়েকটি ইতিহাসখ্যাত সংবাদপত্র প্রকাশিত হত; যেমন—বাঙ্গাল গেজেটি, দিগদর্শন, সমাচার দর্পণ ইত্যাদি।
মার্শম্যানের সম্পাদনায় হুগলীর শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত সমাচার দর্পণ এ রামমোহনের একাধিক লেখা মুদ্রিত হয়েছে। এই পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একেশ্বরবাদী ধর্মভাবনা ও পৌত্তলিকতা বিরোধী মতামত পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তবে কালক্রমে এই পত্রিকার সঙ্গে রামমোহনের মত- পার্থক্য সৃষ্টি হয় এবং সেই সূত্রে তিনি পৃথক সংবাদপত্র প্রকাশে উদ্যোগী হন। সেই প্রয়াসের ফসল রূপে ১৮২১ সালে প্রকাশিত হয় ব্রাহ্মণ সেবধি। এটি ছিল দ্বিভাষিক পত্রিকা—ইংরেজি ও বাংলা দুটো ভাষাতে মুদ্রিত হত। খুব অল্প কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে রামমোহন সম্বাদ কৌমুদী-র সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে যান। ১৮২১ সালের ডিসেম্বরে সম্বাদ কৌমুদী প্রকাশ পায় রামমোহনের উদ্যোগে তারাচাঁদ দত্ত ও ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারা। বাঙ্গাল গেজেটি-র পর সম্বাদ কৌমুদী-ই হল বাংলায় সম্পাদিত ও বাঙালি পরিচালিত দ্বিতীয় সংবাদপত্র। পত্রিকাটি বাংলা, হিন্দি ও পার্সিয়ান –এই তিনটি ভাষায় প্রকাশিত হত। এই পত্রিকাটি সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল বলে জানা যায়।
সম্বাদ কৌমুদী প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই ১৮২২ সালের এপ্রিলে প্রকাশ পায় রামমোহনের বহুখ্যাত ফার্সি সংবাদপত্র মীরাৎ-উল-আখবার। বাংলা থেকে আগাগোড়া ফার্সি ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম সংবাদপত্র। রামমোহন নিজেই এই পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখতেন। এই পত্রিকা সেই সময়ের সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলোকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে এবং সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বেঙ্গল হেরল্ড এর সঙ্গেও রামমোহন অল্প কিছুদিন যুক্ত ছিলেন। জীবনের শেষ নয় বছর তিনি সর্বমোট পাঁচটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাংবাদিকতার প্রতি ঐকান্তিক আগ্রহ এবং ভালোবাসা না থাকলে এমনটা সম্ভব নয়।
সবশেষে বলতে হয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আদায়ে রামমোহনের নিরলস সংগ্রামের কথা—যা ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ১৮২৩ সালে অস্থায়ী গভর্নর জন অ্যাডাম কঠোর প্রেস অর্ডিনেন্স জারি করে ভারতবর্ষের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করেন। এর প্রতিবাদে রামমোহন, দ্বারকানাথ ঠাকুর ও আরও কয়েকজন মিলে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। বিচারপতি সে আবেদন খারিজ করে দিলে তাঁরা ইংল্যান্ডের রাজার কাছে একটি আপিল পাঠান। রামমোহন লিখিত সেই আপিলকে ভারতের ইতিহাসে এক অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সংবাদপত্রের ইতিহাসেও এই আপিলটি এক স্মরণীয় দিকচিহ্ন হয়ে থাকবে চিরকাল। পঞ্চান্ন পত্রের দীর্ঘ এই আবেদনে মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা কীভাবে অপহৃত হল তার বর্ণনা দিয়ে এই দমনমূলক আইন প্রয়োগের ফলে শাসক ও শাসিতের মধ্যে কতটা দূরত্ব তৈরি হতে পারে, এর যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা করা হয়েছে। রামমোহনের এই প্রচেষ্টা ইংল্যান্ডেও সাড়া ফেলেছিল। যদিও সেখানেও এই আবেদন বাতিল হয়ে যায়। তবে রামমোহনের এই লড়াইয়ের ফল পাওয়া গেছে তাঁর প্রয়াণের পর। ১৮৩৮ সালে চার্লস মেটকাফে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার পর সংবাদপত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ বিধি বাতিল করে দেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তথা একজন ভারতীয় নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার সপক্ষে রামমোহনের এই সংগ্রামকে ভারতের জনগণ চিরকাল কুর্নিশ জানাবে।