অনলাইন ডেস্ক : আগরতলার মতো বড় শহরে প্রতি মাসে জলকর দিতে হয় ৪০ টাকা। আর শিলচর পুরসভা আগেই নিত ১২৫ টাকা, বর্তমানে এক লাফে তা আরও বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০০ টাকা। এই পুরসভায় যা চলছে তাকে তুঘলকিরাজ ছাড়া আর কি বলা যায়। পরিষেবার মাধ্যমে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার বদলে করের বোঝা চাপিয়ে পুরসভা যেন উল্টে উৎকন্ঠায় ফেলার খেলা শুরু করেছে। জলকর বৃদ্ধি সহ অন্যান্য ইস্যুতে রবিবার মালুগ্রাম উন্নয়ন মঞ্চ আহুত নাগরিক সভায় এভাবে ক্ষোভ উজাড় করে শহরবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, পুরবোর্ড গঠন না হওয়া পর্যন্ত যেন কেউ জলকর জমা না দেন।
জলকর সহ প্রস্তাবিত শিলচর পুরনিগম এলাকার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য মঞ্চের পক্ষ থেকেএদিন শহরের সার্কিট হাউস রোডে ব্যাংকুয়েট হলে এই নাগরিক সভা আহ্বান করা হয়। সভায় বৃহত্তর শিলচর এলাকার বাসিন্দাদের শামিল করে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে গঠন করা হয় এক নতুন মঞ্চ। “প্রগতিশীল নাগরিক মঞ্চ”-নাম দিয়ে গঠন করা এই মঞ্চের পক্ষ থেকে জলকর না দেওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে শহরের প্রতিটি সড়ক সংস্কার, প্রতিদিন দুবেলা বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ, জমি ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ২০২২ সালের মূল্যায়নকে মান্যতা দেওয়া, ফুলেরতল থেকে হরি টিকর পর্যন্ত বরাক নদী খনন ইত্যাদি দাবিতে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এছাড়া বর্ধিত জলকর সহ অন্যান্য ইস্যুতে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য শহর জুড়ে প্রচার অভিযান চালানোরও সিদ্ধান্ত হয়।
দীর্ঘ সভার শুরুর দিকে পৌরোহিত্য করেন শিক্ষাবিদ নিরঞ্জন দত্ত। শেষের দিকে জরুরী কাজে তাকে চলে যেতে হওয়ায় এই দায়িত্ব অর্পণ করে যান নাগরিক স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মকর্তা হরিদাস দত্তকে। সভার শুরুতে উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমাজকর্মী সাধন পুরকায়স্থ বলেন শিলচর পুরসভায় চলছে তুঘলকি কান্ড। এভাবে হঠাৎ করে জল কর ১২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করে পুরবাসীর পকেট কাটার পেছনে কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। তা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি । শুধু জলকর নয় বিভিন্ন আবেদন পত্রের মূল্যও বৃদ্ধি করা হয়েছে লাগামছাড়াভাবে। নির্বাচিত পুরবোর্ড না থাকা অবস্থায় যেখানে এক টাকাও পুরকর বৃদ্ধি করা যায় না সেখানে এতটা বৃদ্ধি মেনে নেওয়া যায় কিভাবে।
অন্য বক্তা আইনজীবী ধ্রুব কুমার সাহা “ন্যাশনাল জেনেরিক ডকুমেন্ট রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম”(এনজিডিআরএস) এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, এই পোর্টালে শিলচরের বিভিন্ন স্থানের জমির মূল্যায়নের যে তথ্য রয়েছে তা অসম সরকারের ২০২২ সালের মূল্যায়ন থেকে ৪-৫ গুণ বেশি । যার দরুন জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পুরসভা ও সাব রেজিস্ট্রার অফিসে প্রদেয় ফি বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।
কবি-সংবাদিক অতিন দাশ বলেন, শুধু যে মাশুল বৃদ্ধির মধ্যেই আমাদের সমস্যা সীমাবদ্ধ রয়েছে এমন নয়। বেহাল রাস্তাঘাট, জমা জলের সমস্যা ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত ভুগতে হচ্ছে। তিনি ক্ষোভের সুরে বলেন, আমরা শুনতে পাই কেন্দ্র ও রাজ্যে থাকা “ডবল ইঞ্জিন সরকার”-এর জমানায় উন্নয়নের বন্যা বইছে। কিন্তু উন্নয়ন কেমন হচ্ছে তা তো আমরা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। আমরা এগুনোর বদলে শুধু পিছিয়েই যাচ্ছি, আর যারা এখান থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন তারা বরাকের সমস্যা নিয়ে কোনও কথাই বলছেন না।
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ তপোধীর ভট্টাচার্য বলেন, নবগঠিত প্রগতিশীল নাগরিক মঞ্চে সবাইকে নিয়ে গড়ে তুলতে হবে আন্দোলন, এবং এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা থাকাও জরুরী।
অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন সংস্থা সংগঠনের কর্মকর্তা ইলোরা চক্রবর্তী, শিহাব উদ্দিন আহমদ, শান্তি কুমার সিংহ, নির্মল কুমার দাস, দীপক চক্রবর্তী, সঞ্জীব রায়, কৃশানূ ভট্টাচার্য, মনোজ পাল, সুব্রত নাথ, মধুসূধন কর, মাখন পাল, সঞ্জিত দেবনাথ, মৃন্ময় নাথ এবং নন্দদুলাল সাহা। বক্তাদের কেউ কেউ কর বৃদ্ধির সূত্র ধরে পুরসভাকে কসাইয়ের সঙ্গে তুলনা করার পাশাপাশি নিউ শিলচর এলাকায় আগে থেকেই যেভাবে বেশি হারে জল কর নেওয়া হচ্ছিল এনিয়েও ক্ষোভ ব্যাক্ত করেন। উঠে আসে নালার কাজের নামে দীর্ঘদিন ধরে বিবেকানন্দ রোডবাসীকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলে রাখা সহ গোটা শহরের রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা ইত্যাদি প্রসঙ্গও। প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী শহর আগরতলায় মাসে ৪০ টাকা জলকর নেওয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করে প্রশ্ন তোলা হয়, সেখানে এতো কমে জল সরবরাহ করা সম্ভব হলে শিলচরে কেন এভাবে শহরবাসীর মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অত্যাধিক করের বোঝা।
সভার শুরুর দিকে প্রস্তাবনা পাঠ করেন মঞ্চের কর্মকর্তা বাসুদেব শর্মা। প্রস্তাবনা পাঠ করতে গিয়ে তিনি বলেন অসমের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর শিলচরের জনজীবন আজ গভীর সংকটের সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী জনপ্রতিনিধিদের অকর্মণ্যতা, উদাসীনতা ও জেলা প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা।
শেষে সিদ্ধান্তের কথা পাঠ করে শুনান মঞ্চের অন্য কর্মকর্তা কিশোর ভট্টাচার্য। অন্যান্য সিদ্ধান্তের পাশাপাশি জল কর না দেবার আহ্বান নিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে নির্বাচিত পুরবোর্ড নেই। তাই বর্ধিত কর প্রত্যাহারের জন্য দাবি জানানো হলেও কেউই দায়ভার নিতে চাইছেন না। এই অবস্থায় বোর্ড গঠন না হওয়া পর্যন্ত কেউ যেন জল কর জমা না দেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, বিগত দিনে ইচ্ছেমর্জি আকাশছোঁয়া হার বেঁধে দিয়ে পুরসভা সম্পত্তির “সেল্ফ অ্যাসেসমেন্ট”-এর নির্দেশ জারি করেছিল। সেক্ষেত্রেও নাগরিক সভা ডেকে শহরবাসীকে তা জমা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছিল। শহরবাসী এই আহবানে সাড়া দিয়ে তা থেকে বিরত থাকায় চাপে পড়ে সরকার ব্যাপারটা স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়। এবারও জলকর ইস্যুতে একইভাবে কর জমা না দিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া গত্যান্তর নেই।
আন্দোলন কার্যসূচী সম্পর্কে তিনি জানান, প্রথম পর্যায়ে প্রচারপত্র বিলি এবং শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে পথসভা ও কমিটি গঠনের পাশাপাশি পুরসভা সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যালয়ে ধরনা, বিক্ষোভ ইত্যাদি কার্যসূচি হাতে নেওয়া হবে।
সভায় “প্রগতিশীল নাগরিক মঞ্চ”গড়ে এর সভাপতি মনোনীত করা হয়েছে ড: তপোধীর ভট্টাচার্যকে। অন্যান্য পদাধিকারীরা হলেন কার্যকরী সভাপতি ধ্রুব কুমার সাহা, সহ-সভাপতি সাধন পুরকায়স্থ, সিহাব উদ্দিন আহমেদ, বাবুল হোড়, সুব্রত চন্দ্র নাথ, শান্তি কুমার সিংহ, সুজিত কুমার দাস, স্বর্ণালী চৌধুরী, মহিতোষ পাল ও সীমান্ত ভট্টাচার্য। সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব শর্মা, সাংগঠনিক সাধারণ সম্পাদক কিশোর ভট্টাচার্য। সম্পাদক সঞ্জীব রায়, হিল্লোল ভট্টাচার্য, মৃন্ময় নাথ, আব্দুল হাই লস্কর, অরিন্দম দেব, অতনু ভট্টাচার্য, মনোজ পাল, ইলোরা চক্রবর্তী ও পান্না পাল।কোষাধ্যক্ষ মলয় দত্ত, কার্যকরী সদস্য নন্দ দুলাল সাহা, অজয় রায়, রাজীব রায়, সৌমেন চৌধুরী, মধূসুদন কর, রঞ্জিত চৌধুরী, আলী রেজা ওসমানী, সজল বনিক, রেবা নাথ, জয় বরদিয়া, তমাল বনিক, সারদিস কামাই, আদিমা মজুমদার, বিশ্বজিৎ দাস, প্রদীপ নাথ, তরুণ দেব, যাদু চ্যাটার্জী, আজমল হুসেইন চৌধুরী, নিরুপণ ব্যানার্জী, অভিজিৎ ধর, নবদ্বীপ দাস, প্রবীর রায়চৌধুরী, পাবলব লস্কর, পার্থসারথী রায় ও সঞ্জীব দেবনাথ। প্রচার সমন্বয়ক মনোনীত করা হয়েছে তমোজিৎ ভট্টাচার্য, বিশ্বজিৎ দত্ত ও দীলিপ সিংকে ।