বছর পেরোলেই নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়বে। তবে এখন থেকেই শাসক-বিরোধী প্রতিটি রাজনৈতিক দলে শুরু হয়েছে লোকসভা ভোটের কুচকাওয়াজ। ডিলিমিটেশনের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী শিলচর আসনটিকে এবার তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে। ফলে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ভোটের সমীকরণ এবার সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। প্রধান হয়ে উঠেছে জাতপাতের সমীকরণ। তবু শাসকদল বিজেপি শিলচর আসনটি ধরে রাখতে মরিয়া।
ভোটের প্রায় ছ’মাস আগেই বিজেপিতে টিকিট প্রত্যাশীদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। কেউ কেউ তো ডিলিমিটেশনের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর থেকেই নিজেদের প্রার্থিত্বের জন্য গোছাতে শুরু করে দেন। ইতিমধ্যে গেরুয়া শিবিরে প্রার্থিত্বের জন্য মোট পাঁচ জনের নাম শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছেন, রাজ্যের মন্ত্রী তথা বরাক বিজেপির বরিষ্ঠ নেতা পরিমল শুক্লবৈদ্য, শিলচর সাব ডিভিশনাল এসসি বোর্ডের চেয়ারম্যান তথা আইনজীবী নীহাররঞ্জন দাস, দলের জেলা কমিটির সহ-সভাপতি অমিয়কান্তি দাস, প্রদেশ তফসিলি মোর্চার সহ-সভাপতি অমলেন্দু দাস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দক্ষিণ আসাম প্রান্তের সাধারণ সম্পাদক তথা কাছাড় কলেজের অধ্যাপক স্বপন শুক্লবৈদ্য। এই দীর্ঘ তালিকা আলোচনায় থাকলেও এখনও এদের কেউ সরাসরি দলীয় স্তরে টিকিটের দাবি জানাননি। তবে তাদের অধিকাংশের তৎপরতা দেখে ভোটের ময়দানে অবতীর্ণ হতে চাইছেন বলেই মনে হচ্ছে।
জেলা বিজেপির এক সূত্র বলেছেন, শিলচর আসনে পরিমল শুক্লবৈদ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে অন্য কারও দাবি টিকবে না। কারণ তিনি দলের সবচেয়ে সিনিয়র নেতা। অবশ্য তিনি লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক নন বলে ইতিমধ্যে দলীয় স্তরে বারকয়েক মত ব্যক্ত করেছেন। এর ফলে দলের মনোনয়ন পেতে অপেক্ষাকৃত কম সিনিয়রদের তৎপরতা এখন তুঙ্গে। শিলচর আসন তফসিলি সংরক্ষিত হওয়ায় এবার অনেক হেভিওয়েট ব্যক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৌড়ে নেই। শারদোৎসবে জনতাকে শুভেচ্ছা জানানোর যে হিড়িক প্রতিবার দেখা যায়, এবার অনেক তাবড় ব্যক্তির নাম ও ছবি সংবলিত ব্যানার শিলচরে কারও চোখে পড়েনি। তবে বিজেপি টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক, এমন অনেক ব্যক্তির শুভেচ্ছা বার্তা বিভিন্ন মাধ্যমে এবার ছিল উজ্জ্বল।
শিলচর সংরক্ষিত আসনে বিজেপির শক্তিশালী দাবিদার হলেন আইনজীবী নীহাররঞ্জন দাস। তিনি ২০০০ সালে সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেন। গুরুচরণ কলেজ থেকে স্নাতক, আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ, এলএলবি ডিগ্রি নেন করিমগঞ্জ আইন কলেজ থেকে। নীহারবাবু এক সময় রোজকান্দি চা বাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। এমনকী কয়েকবছর তিনি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবেও কাজ করেন। বর্তমানে শিলচর সাব ডিভিশনাল এসসি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে গুরু দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। শিলকুড়িতে লক্ষী নারায়ণ হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। নবোদয় স্কুলে ভর্তির জন্য গরিব ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অনেক সহায়তা করেছেন তিনি। যারা পরবর্তীতে ভর্তির সুযোগ পায়। নীহারবাবু যুব মোর্চার প্রদেশ সাধারণ সম্পাদক পদেও ছিলেন। বিজেপির জাতীয় কার্যনির্বাহী সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন ২০১৭ সালে। জেলা এসসি মোর্চার সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। যুক্ত রয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গেও। বিগত ২২ বছর ধরে সাংগঠনিক বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করার সুবাদে তাঁর সঙ্গে দলের প্রতিটি স্তরের সখ্যতা রয়েছে।
আরেক টিকিট প্রত্যাশী হলেন বিজেপি জেলা কমিটির সহ-সভাপতি অমিয়কান্তি দাস। তিনি আরএসএসের তৃতীয় বর্ষের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন স্বয়ংসেবক। এক সময় ছিলেন একল বিদ্যালয়ের সহ যোজনা প্রমুখ। বিজেপির সদস্য পদ পান ১৯৮৯ সালে। ২০১৪ সালে কাছাড় জেলা বিজেপির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে মনোনীত হন। ২০২১ সালে সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে জেলা কমিটির সহ-সভাপতির পদ সামলাচ্ছেন। অমিয়কান্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক। পেশাগতভাবে তিনি জীবন বিমা নিগমের এজেন্ট। দলের কর্মী মহলে শিলচর আসনে তাঁর নাম জোরালোভাবে উঠে এসেছে।
এই কেন্দ্রের আরেক দাবিদার হচ্ছেন অমলেন্দু দাস। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকে বিজেপিতে এটি অতি পরিচিত নাম। অমলেন্দুবাবু অরুণাচলপ্রদেশ বিধানসভার সচিবালয়ে কাজ করতেন। তাই সংসদীয় রাজনীতিটা দেখেছেন খুব কাছে থেকে। স্বেচ্ছাবসর নিয়ে সরাসরি রাজনীতিতে নামেন গত নির্বাচনে। সেবারের ভোটে তিনি বড়খলায় বিজেপির টিকিটে লড়ে ৫৭৪০২ ভোট পেয়েছিলেন। রাজনীতির বিভিন্ন মারপ্যাঁচে যদিও তিনি শেষপর্যন্ত হেরে যান, তবে বড়খলা আসনে বিজেপি এর আগে এত বেশি সংখ্যায় ভোট পায়নি। বর্তমানে তিনি অসম প্রদেশ তফসিলি মোর্চার সহ-সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর নামও আলোচনায় উঠে এসেছে।
এই দীর্ঘ তালিকার মধ্যে নীরবে আরেকটি নাম উঁকি দিচ্ছে। তিনি হলেন কাছাড় কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক স্বপন শুক্লবৈদ্য। তিনি আবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দক্ষিণ আসাম প্রান্তের সাধারণ সম্পাদক পদেও বৃত। গত সাত বছর ধরে এ দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তাছাড়া বিগত ৩০ বছর ধরে তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের সঙ্গে জড়িত। তফসিলি সম্প্রদায়ের মধ্যেও যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তাঁর। লোকসভা নির্বাচনে অধ্যাপক স্বপন শুক্লবৈদ্যের নাম আলোচনায় থাকলেও তিনি যেহেতু সরকারি চাকরি করছেন, তাই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসতে পারেন না। আগামী এপ্রিলে অবসর নেওয়ার পর এ ব্যাপারে তিনি ভাবনা চিন্তা করবেন বলে জানিয়েছেন।
এই আসনে এবার নির্ঘাত জাতপাতের সমীকরণ প্রাধান্য পাবে। জানা গেছে, নীহাররঞ্জন দাস কৈবর্ত সম্প্রদায়ের। আর অমিয়কান্তি দাস ও অমলেন্দু দাস পাটনি সম্প্রদায়ভুক্ত। এই মুহূর্তে তফসিলিভুক্ত কৈবর্ত ও পাটনি সম্প্রদায়ের এই তিন প্রার্থীর মধ্যেই টিকিটের মূল লড়াই দেখা যাচ্ছে। তবে দল কোন সম্প্রদায়কে এখানে প্রাধান্য দেবে, সেটাও দেখার। তাছাড়া শিক্ষাগত দিকটাও প্রাধান্য পাবে। এই আসনে সুরেশচন্দ্র দেব, জ্যোৎস্না চন্দ, কবীন্দ্র পুরকায়স্থ থেকে শুরু করে বর্তমান সাংসদ রাজদীপ রায় পর্যন্ত সবাই উচ্চশিক্ষিত। তাই এবারও সেরকম কোনও ব্যক্তিকেই টিকিট দেওয়া হবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এ মুহূর্তে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, মর্যাদা সম্পন্ন শিলচর লোকসভা আসন নিয়ে যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তা করেই এগোচ্ছে বিজেপি নেতৃত্ব। কারণ, আসনটি তফসিলি সংরক্ষিত হলেও এখানে বর্ণ হিন্দু ভোটারের প্রভাব বেশি। সেটা ভুললে চলবে না। তাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন, এমন ব্যক্তিকেই দল টিকিট দিতে পারে। সেক্ষেত্রে তালিকায় থাকা কেউ টিকিট পাবেন, নাকি বাইরে থেকে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়, এখন সেটাই দেখার। ###