অনলাইন ডেস্ক : কেন্দ্রীয় ওবিসি হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরীরা। পাল্টা হিসেবে আবার মৈতেই মণিপুরী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সংগঠন এর বিরোধিতা করে আসছে। এই পরিস্থিতির মাঝেই মৈতেই মনিপুরী জনগোষ্ঠীর আগসারির ব্যক্তিত্ব মনিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের কেন্দ্রীয় ওবিসি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের ইস্যুতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি দিলেন দৃঢ় সুরে। জাতি দাঙ্গাকে ঘিরে মনিপুরে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গত কয়েক মাস ধরে সব তিক্ততা ভুলে বরাক উপত্যকায় মৈতেই মনিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী এবং মৈতেই পাঙ্গালদের একসূত্রে বাধার উপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছে বিভিন্ন সংগঠন। মূলত মনিপুর থেকে আসা বার্তার দরুনই এ নিয়ে শুরু হয় নড়াচড়া। এর মধ্যেই অল আসাম মনিপুরী ইয়থস এসোসিয়েশন (আমিয়া)-এর উদ্যোগে এবং
নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী মহাসভা ( অনিল সিংহ গৌতম গুষ্টি)র সহযোগিতায় রবিবার শিলচর শহর সংলগ্ন দুধপাতিল খরিলপারে “মনিপুরী ঐক্য সম্মেলন-২০২৩”-এর আয়োজন করা হয়। এই সম্মেলনে যোগ দিয়ে প্রকাশ্য সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বীরেন সিং বলেন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা কেন্দ্রীয় ওবিসি হিসেবে স্বীকৃতির জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। এই দাবি যাতে পূরণ হয় এর জন্য তিনি অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সঙ্গে মিলে কেন্দ্রের দ্বারস্থ হবেন। বীরেন সিং এদিন মনিপুরী ঐক্যের গান গাইতে গিয়ে সমগ্র বিশ্বের
মৈতেই মনিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী এবং মৈতেই পাঙ্গালদের একসূত্রে গাঁথার উপর জোর দিয়ে বলেন, মনিপুরী জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তা খুবই জরুরী। বারবার মনিপুরী ঐক্য এবং জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপনের মাঝে তিনি বলেন, অসমে বসবাসকারী মনিপুরীদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কয়েকবারই অনুরোধ জানিয়েছেন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে। তখন হিমন্ত বিশ্ব শর্মা তাকে বলেন, অসমে মনিপুরী সমাজ নানাভাবে বিভক্ত। এদের মধ্যে ঐক্য গড়ে না উঠলে এই সমাজের উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া বেশ মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। হিমন্ত বিশ্ব শর্মার প্রসঙ্গ এভাবে উল্লেখ করে তিনি বক্তব্যের মাঝেই সভায় উপস্থিত মৈতেই মনিপুরি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী এবং মৈতেই পাঙ্গাল জনগোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয়দের ডেকে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে বলেন, এরপর নিশ্চয়ই আর মনিপুরীদের মধ্যে অনৈক্য রয়েছে, একথা বলা যাবে না।
বেশ দীর্ঘ বক্তব্য রাখলেও বীরেন সিং অবশ্য একবারও তার রাজ্যের দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলেননি। তবে মায়ান্মারে চলতে থাকা যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, এই পরিস্থিতির জেরে মায়ান্মার থেকে
ছয় হাজারেরও অধিক সংখ্যক লোক পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন মনিপুরে। মানবিকতার দরুন এদের আশ্রয় দিয়ে খাবার দাবার সহ সব ধরনের সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। আর সঙ্গে এও জানান, এদের বায়োমেট্রিক সংগ্রহ করে রাখা হচ্ছে।
সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মনিপুরের দাঙ্গার প্রসঙ্গে নীরব থাকলেও পরবর্তীতে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রাজ্যের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে। দাঙ্গার জেরে রাজ্য ছেড়ে যারা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। বর্তমানে ঠান্ডার মরসুমের মাঝে অনেকেই রাজ্যে ফিরতে চাইছেন না। তবে ঠান্ডার মরশুম শেষ হলেই নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যাবেন তারা।
সভায় বক্তব্য রাখেন বীরেন সিং এর সঙ্গে আসা মনিপুরের মন্ত্রী গোবিনদাস কনথুজামও। তিনি বলেন, মনিপুরীরা একজোট না হলে এগোতে পারবেন না। বিশ্বের যেখানেই মনিপুরীরা রয়েছেন সবাইকে একজোট হয়ে একমঞ্চে আসতে হবে। তিনি জানান, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশেও রয়েছেন মনিপুরীরা। এদিন অসমের মনিপুরীদের সঙ্গে মেলবন্ধনের পর ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের মনিপুরীদের সঙ্গেও যোগাযোগ গড়ে তোলা হবে।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভার কর্মকর্তা তথা
সম্মেলনের যৌথ আয়োজক জিষ্ণু সিনহা বলেন, এদিনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মনিপুরে স্বীকৃতি পেয়ে গেল মহাসভা। মহাসভার মহাসচিব স্বপন সিনহা বলেন, অতীতে যা হয়েছে তা অতীতই। এবার মনিপুরকে রক্ষা করতে সব ভেদাভেদ ভুলে সারা বিশ্বের মনিপুরীদের একত্রিত হওয়া উচিত। এরপর মৈতেই, বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী এবং মৈতেই পাঙ্গালদের একজোট হওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, পূর্ব জার্মানি এবং পশ্চিম জার্মানি যদি এক হতে পারে তবে যেতে পারে তবে মনিপুরীরা কেন পারবেন না। বিশ্বের যেখান যত মৈতেই মণিপুরি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী এবং মৈতেই পাঙ্গাল জনগোষ্ঠীর লোক রয়েছেন, সবার আদিভূমি মনিপুর। মনিপুর রক্ষায় সবাইকে একজোট হতে হবে।
বক্তব্য রাখেন মৈতেই পাঙ্গাল জনগোষ্ঠীর লোক লক্ষীপুরের সাব ডিভিশনাল মেডিক্যাল এন্ড হেলথ অফিসার ডা: তফজ্জুল হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেন, মাতৃভূমি মনিপুর রক্ষায় সব মনিপুরীদের একজোট করার যে প্রয়াস শুরু হয়েছে তা খুবই প্রশংসনীয়। বক্তব্য রাখেন শিলচরের বিধায়ক দীপায়ন চক্রবর্তীর হয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত তার পত্নী রুমলি ভট্টাচার্যও। সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আমিয়ার কর্মকর্তা কোন্দল ক্ষেত্রীমায়ুম। তিনিও জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় মনিপুরী ঐক্য গড়ে তোলার উপর জোর দেন।
অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মনিপুরের মন্ত্রী সুশীন্দ্র সিং, দুই বিধায়ক কে এইচ ইবোমচা সিং ও টি এইচ শান্তি সিং, নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভার কর্মকর্তা রামকৃষ্ণ সিনহা, যোগেন্দ্র কুমার সিনহা প্রমূখ।
এদিনের সভায় মনিপুরী ঐক্যের ডাক দেওয়া হলেও তাৎপর্যপূর্ণভাবে অনুপস্থিত ছিলেন উপত্যকার মৈতেই মনিপুরী জনগোষ্ঠীর প্রথম সারির অনেক ব্যক্তিত্বই। তবে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী মহাসভা (অনিল কৃষ্ণ গৌতম গুষ্টি) র বেশ কয়েকজনকে উপস্থিত হতে দেখা যায়। যদিও মৈতেই পাঙ্গাল জনগোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে ডা: তফজ্জুল হোসেন চৌধুরী ছাড়া বিশেষ কাউকে চোখে পড়েনি।
আর সভাস্থলে প্রায় ১০ হাজার চেয়ার বসানো হলেও ভরেনি অর্ধেকটাও। তাই অনুষ্ঠানের মাঝেই একসময় আয়োজকদের দেখা যায়, পেছনের দিকের চেয়ার গুলো গুটিয়ে রেখে দিতে।