অনলাইন ডেস্ক : রবীন্দ্রনাথকে আমরা মূলত ভাববিলাসী ও রসলোকবিহারী পরিচয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে ভালোবাসি। কিন্তু তিনি যে কত বড় মাপের সমাজচিন্তক ও দেশহিতৈষী—সে কথা আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। অথচ প্রথম জীবনে শিলাইদহে গ্রামোন্নয়ন থেকে শুরু করে শেষ জীবনে শ্রীনিকেতন কর্মযজ্ঞে তাঁর ভাবনাকে সাকার করে তোলা—এই বৃহৎ সমাজচিন্তার পরিসরকে কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখক জীবনের শুরু থেকেই স্বদেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেছেন। জীবনের গোধূলি পর্বে এসে সেই ভাবনারই পূর্ণ রূপায়ণ ঘটিয়েছেন শ্রীনিকেতন ও তার আশেপাশের পল্লীসেবার মাধ্যমে। এই সমস্ত কাজের মধ্য দিয়ে যে কথাটি তিনি প্রধান ভাবে বলতে চেয়েছেন—তা হল আমাদের দেশের মানুষকে হতে হবে আত্মনির্ভর। ভারতীয় পল্লীসমাজে যে আত্মশক্তি নিহিত রয়েছে , সবাইকে তার বিকাশের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। আমাদের দেশের সমস্ত শক্তি, সাধনা ও সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি হচ্ছে পল্লীগ্রাম। তাই গ্রামের যথার্থ বিকাশের মাধ্যমেই স্বদেশ সঠিক অর্থে উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারবে বলে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন।
রবীন্দ্রনাথের পল্লীচিন্তার আসল সত্যকে দেখতে পাওয়া যাবে তাঁর গ্রামের কাজের মধ্যে। প্রথমে শিলাইদহের বিরাহিমপুর, সাহাজাদপুর, কালিগ্রাম পরগণায় নিজেদের জমিদারিতে এবং পরে বীরভূমের সুরুল-শ্রীনিকেতনে। শিলাইদহ অঞ্চলে বাসকালে তিনি গ্রামের বাস্তব অবস্থার প্রত্যক্ষ পরিচয় পান। কর্মের ক্ষেত্রে নিজের পল্লীচিন্তার রূপায়ণ সেই সময় থেকে শুরু হয়। সেই সময় তিনি কুষ্টিয়ায় তাঁতের কারখানা ও বয়ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিরাহিমপুর ও কালিগ্রামের কয়েকটি পল্লীকে একসঙ্গে নিয়ে একটি বিচার সভা ও আপিল সভা প্রতিষ্ঠিত করেন। এই সময় ‘কালিগ্রাম হিতৈষী সভা’ নামে একটি নির্বাচন-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন কালিগ্রামে। সেই সভার উদ্যোগে গ্রামে বিদ্যালয়, চিকিৎসালয় স্থাপিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানে গ্রামবাসীরা মিলিতভাবে পথঘাট নির্মাণ, পুকুর পুনরুদ্ধার, জঙ্গল পরিষ্কার, কুটির শিল্পের উন্নয়ন, মাছের চাষ, ধর্মগোলা স্থাপন প্রভৃতি নানা কাজে হাত দেন। ১৯০৫ সালে পতিসরে একটি কৃষি ব্যাঙ্ক স্থাপিত হয়। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষার জন্য রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকা পাঠান। ১৯১২ সালে পতিসরে বয়ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এই সমস্ত কর্মকাণ্ডকে রবীন্দ্রনাথের পল্লী সংগঠনের প্রাথমিক প্রয়াসের খসড়া বলা যায়। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় চেষ্টা ছিল গ্রামবাসীদের নিজেদের উদ্যোগ, কর্মশক্তি ও সংগঠনশক্তিকে ফিরিয়ে আনা, তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। এ সমস্তই যেন ভেতর থেকে হয়, সেদিকে রবীন্দ্রনাথের সজাগ দৃষ্টি ছিল। তিনি সবসময় চাইতেন গ্রামবাসীরা নিজেদের চেষ্টায় গ্রামে গ্রামে সংগঠন গড়ে তুলুক। এভাবেই তারা সামগ্রিকভাবে আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে।
শিলাইদহ পর্ব থেকে শ্রীনিকেতন পর্ব অনেক বেশি পরিণত। শ্রীনিকেতন পর্বে তাঁর কৃষিভাবনা, পল্লী উন্নয়ন ভাবনা, গ্রামীন শিল্পভাবনা আরও অনেক বেশি সংহত। পরিবেশ নিয়েও তখন তিনি আরও গভীরভাবে চিন্তা করছেন। জৈব সার, কৃষি-সমবায় ইত্যাদির ভাবনায় তিনি তখন সমৃদ্ধ। সাংগঠনিক প্রশ্নেও শ্রীনিকেতনের মুহূর্তে তিনি আরও বেশি অভিজ্ঞ। জলকষ্ট, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি সমস্যা সে সময় শ্রীনিকেতন ও তার আশেপাশের পল্লীগ্রামকে জীর্ণ-দীর্ণ করে তুলেছিল। মানবপ্রেমী রবীন্দ্রনাথ বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন এ সমস্ত প্রত্যক্ষ করে এবং কয়েকজন সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে এর সমাধানে নিজের মন প্রাণ নিয়োগ করেছিলেন। শ্রীনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে স্মরণীয় কাজ হল গ্রামের ছেলেমেয়েদের বৃত্তিমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ‘শিক্ষাসত্র’প্রতিষ্ঠা করা। শ্রীনিকেতনে গ্রামের প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রামীণ অর্থনীতি ও গ্রামবাসীর জীবনযাত্রার সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে কারিগরি বিদ্যাকেও কাজে লাগিয়েছেন–সেসময়ের সীমিত অর্থসংস্থানে যতটুকু সম্ভব ছিল। গ্রামে গ্রামে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার, ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল, গ্রামবাসীদের নিজেদের উদ্যোগে এবং সম্পূর্ণ নিজেদের অধিনায়কত্বে রাস্তাঘাট নির্মাণের অভিযান ছিল, পুকুর খনন এবং নলকূপ বসানোর প্রয়াস ছিল। শহরের সঙ্গেও শ্রীনিকেতনের কোন অসহযোগিতা ছিল না; গ্রাম ও শহরের একটা পারস্পরিক পরিপূরকতার সম্পর্ক সৃষ্টি করাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। পরবর্তীকালে সরকারি উদ্যোগে ব্লক উন্নয়নের যে কর্মচেষ্টা আমরা দেখতে পাই, তার অনেকটাই শ্রীনিকেতন কর্মকাণ্ডের অনুরূপ।
রবীন্দ্রনাথের সমবায় চিন্তাও এদিক থেকে অনেক ঋদ্ধ। একসঙ্গে সব চাষিরা মিলে চাষের কাজে হাত লাগানোর কথা বলেছেন তিনি। রাসায়নিক সারের বিপদ বিষয়ে তিনি সচেতন। রাসায়নিক সার প্রকৃতি ও পরিবেশের পক্ষে যে অনুকূল নয়, এই বোধ তখনই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পরিষ্কারভাবে ছিল। তাই এর বদলে জৈব সারের প্রয়োগের উপর জোর দিয়েছেন। প্রকৃতি-পরিবেশ-মানুষ-সমাজ ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়ে যে সংহত জীবনবৃত্তের কল্পনা করতেন তিনি তাতে এই বিচিত্র দিকে যে তাঁর নজর থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়, নিজেদের কিছুটা ক্ষতি স্বীকার করে নিয়েও তিনি স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারের পক্ষপাতি ছিলেন। আমাদের দেশের অর্থ যাতে বিদেশে চলে না যায়, এর জন্য নিজের দেশের তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহারের ব্যাপারে সমস্ত দেশবাসিকে উৎসাহিত করেছেন। বস্তুত এ সবই তাঁর দিক থেকে এক রকমের আত্মপ্রকাশ। কৃষির ক্ষেত্রে তিনি বুঝেছিলেন, সব চাষিদের আলাদা আলাদা টুকরো জমি একসাথে মেশাতে পারলে বড় খামারের জমিতে পৌঁছনো যায়। তখন চাষে যন্ত্রপাতির ব্যবহারও সম্ভব হয়। রবীন্দ্রনাথ তো সাধারণভাবে আধুনিক প্রযুক্তিবিমুখ মানুষ নন। তবে তাঁর প্রযুক্তিচিন্তা সমাজ ও মানব-সম্পর্কের বাইরে নয়। যে কারণে চাষে যন্ত্রপাতির ব্যবহারে তিনি আগ্রহী। সমবায় পদ্ধতিতে কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া—রবীন্দ্রনাথের এই গ্রাম ভাবনা ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী সমাজ গঠনেরই অঙ্গ। সত্যি বলতে কি তাঁর সমস্ত রচনা, কর্ম আর সৃষ্টিজীবন আসলে এক সংহত ঐক্যে দানা বাঁধতে চেয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন, গ্রামবাসীরা নিজেদের ভিতরের সব সম্ভাবনাকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাক এবং এতে যতটা সাহায্য দরকার সেটা তিনি জোগাবেন।
রবীন্দ্রনাথ এই উন্নয়নের স্বরূপ বোঝাতে গিয়ে বারবার একটি কথা বলেছেন যে, বাইরে থেকে কারো পক্ষে গ্রামের যথার্থ উন্নতি করা সম্ভব নয়। ওই গ্রাম্য সমাজের অন্তরেই সেই প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়া চাই। জন হিতৈষণা তা সে যতই বিশুদ্ধ হোক না কেন, আপন প্রাণের তাজা স্পর্শের চেয়ে দামি হতে পারে না। চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা এমনকি বাস্তব উপকরণের সহায়তাও গ্রামের বাইরে থেকে আসতে পারে; কিন্তু এ সমস্তকে গ্রহণ করতে হবে সতেজ প্রাণে। সেই প্রাণকে জাগিয়ে তোলা, বাঁচিয়ে রাখা গ্রামসমাজের নিজের দায়িত্ব। তবেই একটি সমাজ যথার্থ আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনা আজও আমাদের দেশে প্রাসঙ্গিক। শুধু এটাই প্রশ্ন যে সেই ব্যাপ্ত ভাবনার সামনে আমরা নিজেদের কীভাবে দাঁড় করাবো? বর্তমান সময়ের উপযুক্ত কোন্ ধরণের প্রকল্প আমরা রবীন্দ্রনাথের গ্রামভাবনা থেকে আবার নতুন করে গ্রহণ করতে পারি, এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি আজ দেশের স্বার্থে আত্মনির্ভর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে আমরা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে এগোতে পারি, তবে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় সার্থকতা।