লালনের গান : ভালো থাকার পাসওয়ার্ড
কল্যাণ মুখোপাধ্যায়
লালন ফকিরের নামের সঙ্গে আপামর মানুষ পরিচিত। তাঁর গানই তাঁর পরিচয়। লালনগীতি আজ ইউটিউবে সার্চ করলে সহজেই পাওয়া যায়। লালনের গান তো শুধু গান নয়, এক জীবনবোধ, এক দর্শন। তাঁর গান জীবনে ভালো থাকার পাসওয়ার্ড। কে তিনি, কি তাঁর পরিচয় এই নিয়ে বহু নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতেও হবে। লালনের মূল পদবী কর। কিন্তু মুসলমান ঘরে মানুষ হবার কারণে হিন্দু সমাজ তাকে আর গ্রহণ করে নি। প্রথম জীবনে এই সংকটের কারণে লালু হয়ে উঠেছিল লালন ফকির। গুরু হিসাবে পেয়েছিলেন সিরাজ সাঁইকে। জাত ছিল তার কাছে খোলস মাত্র। তাকে জীবনের প্রথম পর্যায়ে বিসর্জন দিয়ে শুধু মানুষ হবার সাধনার কথা আজীবন বলে গেছেন তার গানে। হিন্দু মুসলমান বা কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম নয়, নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন মানুষ হিসাবে এবং পরবর্তী সমাজকে দিয়েছেন অসীম প্রেরণা। লালন মনে করতেন যা মানুষের পক্ষে কল্যাণকর তাই পুণ্য, যা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর তাই পাপ। পাকিস্থানের কিছু গবেষক লালনকে বিশুদ্ধ মুসলমান বলে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, আবার অনেকে চেষ্টা করেছেন প্রমাণ করতে যে তিনি হিন্দু। এইসব অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, যদিও বাংলাদেশের কিছু ধর্মান্ধ আজও মরিয়া চেষ্টা করে চলেছেন লালনকে মুসলমান প্রমাণ করার। তাকে ইসলামি সমাজভুক্ত প্রমাণ করার জন্য দুদ্দু শার নামে জাল পুঁথিও তারা বের করছে। এমনকি লালনের পদের শব্দ বদলে দিয়ে ইসলামি শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। সমস্যা আরো জটিল হয়ে ওঠে, যখন বিখ্যাত কোনো গায়ক বা গবেষক সেই জাল গানকেই লালনের গান বলে মেনে নেন। মানুষ সেটিকেই বিশ্বাস করে নেয়। যেমন, ‘ বলি আয় রে মুসলিম যায় রে মসজিদ সাঝেরও বেলায়’ গানটি লালনের লেখা না হওয়া সত্ত্বেও লালনগীতি বলে রেকর্ড করা হয়েছে। এইসব ধর্মান্ধদের জন্য লালনের শুধু নামটুকুই যথেষ্ট। নামের আগে কিছু নেই, পরেও কিছু নেই। আগে বা পরের লেজুড়গুলোই আমাদের জাতি বা পদবী নিয়ে যাবতীয় অহংকারের মূলে অবস্থান করে। কিন্তু লালন তার গানে বারবার বলেছেন, শুধু মানুষের ভজনা করলেই অন্তর থেকে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠা সম্ভব। তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, মানুষ ছাড়া খ্যাপা রে তুই মূল হারাবি’। লালনকে বিশুদ্ধ হিন্দু মুসলমান বা সুফী হিসাবে যারা দেখতে চাইবেন তারা হতাশ হবেন। বাউল দেবতা শাস্ত্রকে সত্য বলে মানে না, তাদের কাছে মানুষ একমাত্র সত্য। তারা কায়াবাদী, এই দেহেই সব সত্য সব শক্তি লুকিয়ে আছে বলে তারা বিশ্বাস করে। কুবীর গোঁসাই এর গানে সেকথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে— ‘মানুষ হয়ে মানুষ মানো / মানুষ হয়ে মানুষ জানো / মানুষ হয়ে মানুষ চেনো / মানুষ রতনধন / করো সেই মানুষের অন্বেষণ ।” স্বাভাবিকভাবেই প্রথাগত ঈশ্বরকে না মানলে ধর্মের ধ্বজাধারীরা রুষ্ট হবেন। তাই যুগে যুগে বাউল ফকিরদের উপর অত্যাচার হয়, আজও হয়ে চলেছে। মাধুকরী করে যে সমস্ত বাউল ফকিরদের জীবন চলে তাদের জোর করে নামাজ পড়ানোর চেষ্টা চলছে, না পড়লে সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করা হচ্ছে, গ্রামে ভিক্ষা করতেও দেওয়া হচ্ছে না—এমন উদাহরণ চোখের সামনে অসংখ্য। প্রশাসনকে জানিয়ে কোনো কাজ হয় না । রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন বাউলদের ঈশ্বর কোথায় আর তা সাধারণের থেকে কোথায় আলাদা। তিনি বলেছিলেন – “ শাস্ত্রের যে ভগবান, ধর্মকর্মের ব্যবহারে লাগেন, যিনি সনাতনপন্থী ধার্মিক লোকের ভগবান, তাঁকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক শ্লোক চলে; তাঁর জন্যে অনেক মন্ত্রতন্ত্র; আর যে ভগবানকে নিজের আত্মার মধ্যে ভক্ত সত্য করে দেখেছেন, যিনি অহৈতুক আনন্দের ভগবান, তাঁকে নিয়েই গান গাওয়া যায়।” বাউলের গান এই জন্যই সৃষ্টি হয়েছে ।
লালনকে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতায় এতটাই ভুগতে হয়েছে যে, তিনি বলেছিলেন, জাতের রূপ কেমন, তার আকার কেমন, সেটা কি দেখা যায় ? জাতকে হাতে পেলে তাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতেন। লালনের মৃত্যুর পর প্রায় একশো তিরিশ বছর অতিক্রান্ত, জন্মেরও প্রায় আড়াইশো বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু পরিস্থিতির কি বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে ? এখনো তো লালন কোন জাতের মানুষ সেই নিয়েই ধর্মান্ধরা মেতে আছে। ব্রাহ্মণ বাড়িতে পৈতে না দিলে ব্রাহ্মণত্ব আসে না, মুসলিম বাড়িতে মুসলমানী অনুষ্ঠান না হলে বাচ্ছা ছেলেকে মুসলমান বলা যায় না! লালন খুব সরলভাবে সমাজপতিদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছেন, ছোন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীজাতির কি হয় বিধান ? বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি কী প্রকারে! এর যথাযথ উত্তর দিতে না পেরেই সমাজপতিরা লালনের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, আজও হন। কিন্তু এমন গভীর প্রশ্ন লালন এত সহজ ভাষায় করলেন কিভাবে! করতে পারলেন এইজন্যই যে, লালন শুধু কবি নন, তিনি একজন দার্শনিক। অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী লালনকে যুক্তিবাদী দার্শনিক বলেছেন। কত সহজভাবে লালন বলেছেন যে মৃত্যুর হাত থেকে তো কারোর নিস্তার নেই, তাহলে মানুষের মধ্যে বড়ো ছোটো হয় কি করে— “ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি, এক জলে সব হয় রে শুচি, দেখে শুনে হয় না রুচি, যমে তো কাউকে ছাড়বে না।” বর্তমান সাম্প্রদায়িক সমাজে এর থেকে বড়ো সত্য আর কি বা হতে পারে! লালন যেখানে একমাত্র মানুষকেই অবলম্বন করতে বলেছেন, সেখানে আজ আমাদের একমাত্র অবলম্বন জাত আর ভেদ। মুক্তির একমাত্র উপায় লালনের গান শোনা আর তাকে জীবনের পথে কাজে লাগানো। কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ না করলে তা সম্ভব নয়। কিন্তু ‘সভ্য’ সমাজ তা শুনবে কি !