স্বরাজ সাধনায় নারী
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
(শেষ পর্ব)
আমার জীবনের অনেকদিন আমি Sociology-র (সমাজতত্ত্ব) ছাত্র ছিলাম। দেশের প্রায় সকল জাতিগুলিকেই আমার ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখবার সুযোগ হয়েছে,–আমার মনে হয় মেয়েদের অধিকার যারা যে পরিমাণে খর্ব করেছে, ঠিক সেই অনুপাতেই তারা, কি সামাজিক, কি আর্থিক, কি নৈতিক সকল দিক দিয়েই ছোট হয়ে গেছে। এর উলটো দিকটাও আবার ঠিক এমনি সত্যি। অর্থাৎ, যে জাতি যে পরিমাণে তার সংশয় ও অবিশ্বাস বর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, নারীর মনুষ্যত্বের স্বাধীনতা যারা যে পরিমাণে মুক্ত করে দিয়েছে,–নিজেদের অধীনতা-শৃঙ্খলও তাদের তেমনি ঝরে গেছে। ইতিহাসের দিকে চেয়ে দেখো। পৃথিবীতে এমন একটা দেশ পাওয়া যাবে না যারা মেয়েদের মানুষ হবার স্বাধীনতা হরণ করেনি, অথচ তাদের মনুষ্যত্বের স্বাধীনতা অপর কোন প্রবল জাত কেড়ে নিয়ে জোর করে রাখতে পেরেছে। কোথাও পারেনি—পারতে পারেও না, ভগবানের বোধ হয় তা আইনই নয়। আমাদের আপনাদের স্বাধীনতার প্রযত্নে আজ ঠিক এই আশঙ্কাই আমার বুকের উপর জাঁতার মত বসে আছে। মনে হয় এই শক্ত কাজটা সকল কাজের আগে আমাদের বাকি রয়ে গেছে, ইংরাজের সঙ্গে যার কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। কেউ যদি বলেন, কিন্তু এই এশিয়ায় এমন দেশও ত আজও আছে, মেয়েদের স্বাধীনতা যারা একতিল দেয়নি, অথচ তাদের স্বাধীনতাও ত কেউ অপহরণ করেনি। অপহরণ করবেই এমন কথা আমি বলিনি। তবুও আমি এ কথা বলি, স্বাধীনতা যে আজও আছে সে কেবল নিতান্তই দৈবাতের বলে। এই দৈব বলের অভাবে যদি কখনও এ বস্তু যায়, ত আমাদেরই মত কেবলমাত্র দেশের পুরুষের দল কাঁধ দিয়ে এ মহাভার সূচ্যাগ্রও নড়াতে পারবে না। শুধু আপাত দৃষ্টিতে এ সত্যের ব্যত্যয় দেখি ব্রহ্ম দেশে। আজ সে দেশ পরাধীন। একদিন সে দেশে নারীর স্বাধীনতার অবধি ছিল না। কিন্তু যে দিন থেকে পুরুষে এই স্বাধীনতার মর্যাদা লঙ্ঘন করতে আরম্ভ করেছিল, সেই দিন থেকে, একদিকে যেমন নিজেরাও অকর্মণ্য, বিলাসী এবং হীন হতে শুরু করেছিল, অন্যদিকে তেমনি নারীর মধ্যেও স্বেচ্ছাচারিতার প্রবাহ আরম্ভ হয়েছিল। আর সেই দিন থেকেই দেশের অধঃপতনের সূচনা। আমি এদের অনেক শহর, অনেক গ্রাম, অনেক পল্লী অনেক দিন ধরে ঘুরে বেড়িয়েছি, আমি দেখতে পেয়েছি তাদের অনেক গেছে কিন্তু একটা বড় জিনিস তারা আজও হারায় নি। কেবলমাত্র নারীর সতীত্ব টাকে একটা ফেটিস করে তুলে তাদের স্বাধীনতা তাদের ভালো হবার পথটাকে কণ্টকাকীর্ণ করে তোলেনি। তাই আজও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, আজও দেশের ধর্ম-কর্ম, আজও দেশের আচার-ব্যবহার মেয়েদের হাতে। আজও তাদের মেয়েরা একশতের মধ্যে নব্বুইজন লিখতে পড়তে জানে, এবং তাই আজও তাদের দেশ থেকে আমাদের এই হতভাগ্য দেশের মত আনন্দ জিনিসটা একেবারে নির্বাসিত হয়ে যায়নি। আজ তাদের সমস্ত দেশ অজ্ঞতা, জড়তা ও মহের আবরণে আচ্ছন্ন হয়ে আছে সত্য, কিন্তু একদিন, যেদিন তাদের ঘুম ভাঙবে, এই সমবেত নরনারী একদিন যেদিন চোখ মেলে জেগে উঠবে, সেদিন এদের অধীনতার শৃঙ্খল, তা সে যত মোটা, যত ভারীই হোক, খসে পড়তে মুহূর্ত বিলম্ব হবে না, তাতে বাধা দেয় পৃথিবীতে এমন শক্তিমান কেউ নেই।
আজ আমাদের অনেকেরই ঘুম ভেঙেছে। আমার বিশ্বাস এখন দেশে এমন একজনও ভারতবাসী নেই যে এই প্রাচীন পবিত্র মাতৃভূমির নষ্ট-গৌরব, বিলুপ্ত-সম্মান পুনরুজ্জীবিত না দেখতে চায়। কিন্তু কেবল চাইলেই তো মেলে না, পাবার উপায় করতে হয়। এই উপায়ের পথেই যত বাধা, যত বিঘ্ন, যত মতভেদ। এবং এইখানেই একটা বস্তুকে আমি তোমাদের চিরজীবনের পরম সত্য বলে অবলম্বন করতে অনুরোধ করি। এ কেবল পরের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা। যার যা দাবী, তাকে তা পেতে দাও। তা সে যেখানে এবং যারই হোক। এ আমার বই-পড়া বড় কথা নয়, এ আমার ধার্মিক ব্যক্তির মুখে শোনা তত্ত্বকথা নয়—এ আমার এই দীর্ঘ জীবনের বার বার ঠেকে শেখা সত্য। আমি কেবল এটুকু দিয়েই অত্যন্ত জটিল সমস্যার এক মুহূর্তে মীমাংসা করে ফেলি, আমি বলি মেয়েমানুষ যদি মানুষ হয়, এবং স্বাধীনতায়, ধর্মে, জ্ঞানে—যদি মানুষের দাবী আছে স্বীকার করি, ত এ দাবী আমাকে মঞ্জুর করতেই হবে, তা সে ফল তার যাই হোক। হাড়ী ডোমকে যদি মানুষ বলতে বাধ্য হই, এবং মানুষের উন্নতি করবার অধিকার আছে এ যদি মানি, টাকে পথ ছেড়ে আমাকে দিতেই হবে, তা সে যেখানেই গিয়ে পৌঁছাক। আমি বাজে ঝুঁকি ঘাড়ে নিয়ে কিছুতেই তাদের হিত করতে যাই নে। আমি বলিনে, বাছা তুমি স্ত্রীলোক, তোমার এ করতে নেই, বলতে নেই, ওখানে যেতে নেই,–তুমি তোমার ভালো বোঝ না—এস আমি তোমার হিতের জন্যে তোমার মুখে পর্দা এবং পায়ে দড়ি বেঁধে রাখি। ডোমকেও ডেকে বলিনে, বাপু, তুমি যখন ডোম তখন এর বেশি চলাফেরা তোমার মঙ্গলকর নয়, অতএব এই ডিঙ্গোলেই তোমার পা ভেঙে দেব। দীর্ঘদিন বর্মা দেশে থেকে এটা আমার বেশ ভালো করে শেখা যে, মানুষের অধিকার নিয়ে গায়ে পড়ে মেলাই তার হিত করবার আবশ্যক নেই।
… আজ তোমাদের কাছে আমার আরও অনেক কথা বলবার ছিল। সকল দিক দিয়ে কি করে সমস্ত বাঙ্গালা জীর্ণ হয়ে আসছে,–দেশের যারা মেরুমজ্জা সেই ভদ্র গৃহস্থ পরিবার কি করে কোথায় ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে আসছে, সে আনন্দ নেই, সে প্রাণ নেই, সে ধর্ম নেই, সে খাওয়া-পরা নেই; সমৃদ্ধ প্রাচীন গ্রাম গুলা প্রায় জনশূন্য,–বিরাট প্রাসাদ তুল্য আবাসে শিয়াল কুকুর বাস করে; পীড়িত, নিরুপায় মৃতকল্প লোকগুলো যারা আজও সেখানে পড়ে আছে, খাদ্যাভাবে, জলাভাবে কি তাদের অবস্থা,–এইসব সহস্র দুঃখের কাহিনী তোমাদের তরুণ প্রাণের সামনে হাজির করবার আমার সাধ ছিল, কিন্তু এবার আমার সময় হলো না। … আজ আমাকে তোমরা ক্ষমা কর।
(সংক্ষেপিত)
(১৩২৮ সালে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ছাত্রদের সভায় পঠিত অভিভাষণ। প্রথম পর্বে এ সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।)