অনলাইন ডেস্ক : ভুল বা ঠিকের তোয়াক্কা না করেই দেওয়াল থেকে ছিঁড়ে ফেললাম সাধের টাঙানো আরও একটি ক্যালেন্ডার। বছরটা গড়গড়িয়ে চলে গেল অতীতের খাদে। যেখানে হাসি আছে কান্না আছে, রয়েছে আশা ভরসার হাতছানি। পাওয়া , না পাওয়ার হালখাতাটাও বেশ সমৃদ্ধ। জীবনের পাটিগণিতে আপাতত ‘মাইনাস ‘ সাল ২০২৩।
অস্তির একটা সমাবেশ। গোলোকটা যেন ভরে গেছে অশান্তিতে। যুদ্ধ, হানাহানি, প্রকৃতির রোষ – শান্তিতে ঠায় দাঁড়ানোর জন্য না আছে মাটি না রয়েছে অবকাশ। আমার দেশ বলুন কিংবা পরের অস্তিরতাই যেন যুগের ভবিতব্য। আপন পর, ধনী দরিদ্র, সাদা কালো ভেদাভেদে চেনা এই গোলার্দোটা হয়ে উঠেছে অচেনা।
যুদ্ধই যেন হয়ে উঠেছে ন্যায়ের নতুন রূপ। এখানে কোনও রুলই আর কাজ করছে না। মানবতা, বিবেকবোধ এসব যাক না চুলোয়। রাশিয়ার আগ্রসনে ইউক্রেনে কান্না ততক্ষনে থামেনি, এরমধ্যেই আবার ইজরায়েলি বর্বরতার ‘ বসন্ত ‘ উঁকি দিয়ে দিল প্যালেস্তাইনে। হিব্রু দেশের হিংস্রতার রক্তমাখা ঝরনায় ভিজছে মরুর বুকের ছোট্ট এই দেশটা। আদিম বর্বরতায় মৃত্যু উপত্যকায় খালি হচ্ছে অসংখ্য মায়ের কোল।
সব যুদ্ধ রক্তে লেখা, কিন্তু সব যুদ্ধের লেখা এক নয়। সভ্যতার উপর সুগভীর, সুব্যাপ্ত প্রভাব রেখে যাওয়ার মতো যুদ্ধ হয় কয়েকটিই মাত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কম সংঘর্ষ দেখেনি পৃথিবী, কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ, এবং প্যালেস্তাইনে যে দাগ রেখে যেতে চলেছে গোটা বিশ্বের সর্ব ক্ষেত্রে, তার তুল্য ঘটনা দুর্লভ। এ যুদ্ধ, ধ্বংসলীলা আদৌ ‘শেষ’ হবে কি না, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। এক অনন্ত ক্ষত থেকে রক্ত ঝরতেই থাকবে, বাকি বিশ্বকে সংক্রামিত করেই চলবে, এমন আশঙ্কার মধ্যেই আজ একটি নতুন বছরের সূচনা।
গোটা দুনিয়ায় সাধারণ মানুষ কেন উগ্র দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকছে, এই এই মুহূর্তে এই প্রশ্নটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে। ধনী দেশ-দরিদ্র দেশ নির্বিশেষে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
গেল বছরগুলিতে শীতঘুমে থাকলেও করোনা – সুর কিন্তু আবার জেগে উঠেছেন। এই বছরটা প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে, বিপদ কি নতুন উদ্যমে ফিরে আসবে? বছরের শুরুতে বিপুল সংক্রমণের সংবাদে ঘরপোড়া দুনিয়ার আতঙ্ক অহেতুক নয়। চিনা সীমান্ত পেরিয়ে নতুন রূপে আজ ভারত সহ গোটা বিশ্বে আতঙ্কের বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছে করোনা। তবে আশা এই যে, অধিকাংশ বিশ্ববাসী ইতিমধ্যে প্রতিরোধী ক্ষমতা সংগ্রহ করেছেন, সুতরাং সংক্রমণ ঘটতে থাকলেও অতিমারির রুদ্রমূর্তি ফিরবে না। আপাতত সতর্কতা জরুরি, আতঙ্ক নয়। তেমনি হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া বিশ্ব অর্থনীতিও সেই দাবিই জানাচ্ছে। হানাহানির অভিঘাত সামলে এই বছরটিতে বিশ্ব অর্থনীতি নিজের নববধূর রূপে ফিরতে চাইছে । কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় এক বিরাট ধাক্কা দিয়েছে রাশিয়া- ইউক্রেন সংঘাত, প্যালেস্তাইন আগ্রাসন সহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যা এখনও অব্যাহত। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিশ্ব জুড়ে, বিশেষত পশ্চিম দুনিয়ায় চলছে মূল্যস্ফীতি এবং মন্দার সাঁড়াশি আক্রমণ। তার পাশাপাশি আছে প্রকৃতি-পরিবেশের দুর্বার অবক্ষয়। দুবাইয়ে জলবায়ু বিষয়ক বার্ষিক সম্মেলনে রাষ্ট্রনায়কেরা এই ক্ষয় রোধের পথে এগিয়েছেন বটে, তবে বড়জোর আড়াই পা। সামগ্রিক ভাবেই ২০২৩ সাল দেখিয়ে দিল, অতিমারির বিপর্যয়ও দুনিয়াদারদের সম্বিৎ ফেরাতে পারেনি, ক্ষুদ্র এবং স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের নির্দেশেই তাঁদের রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি এবং কূটনীতি পথ চলছে। সর্বনাশের পথ। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের অভিজ্ঞতাকে স্থিতিশীল বললে ভুল হবে না। দক্ষিণ এশিয়ায় তো বটেই, বৃহত্তর বিশ্বেও এ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি উপরের সারিতে। তার পিছনে সরকারের কৃতিত্ব অবশ্য যৎসামান্য, সুচিন্তিত কোনও আর্থিক নীতি তাঁদের চিন্তার ত্রিসীমানায় নেই, সাঙাততন্ত্রের সাধনা ভিন্ন তাঁরা দৃশ্যত কিছুই বোঝেন না। ভারতীয় অর্থনীতি তার নিজস্ব শক্তিতেই চলছে। মোদি সাহেব নিজের দলবল নিয়ে বিকাশের ভারতকে নতুন রূপ দিতে কোনও কার্পণ্য করছেন না। রাম মন্দির হয়ে গেছে, কাশ্মীরেরও ৩৭০ রদ হয়ে গেছে। অর্ধেক দেশে উড়ছে গেরুয়া পতাকা। বিরোধীরা আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন। দেশ প্রাণখুলেই বলছে ‘ জয় শ্রী রাম ‘। বিতর্ক তিতর্কর ধার না ধরেই বলব – ‘ আমরা আছি, বেশ আছি। ‘ দেশ হাসছে তাই আমরাও….।
মন খারাপির তালিকাটাও নেহাত ছোট নয়। দেশের মাঠে আমরা বিশ্বজয়ে সফল হইনি। দারুন একটা শোয়ের পরও সেকেন্ড বেস্ট হতে হল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মনিপুরের জাতি দাঙ্গা, ট্রেন দুর্ঘটনা। শান্তির এই সাদা কাগজে একটা অশান্তির কালো দাগ ছেড়ে গেল মনিপুরের মৈতে, কুকি সংঘর্ষ। সোজাসাপ্টা প্রশ্নটা হল এই গৃহযুদ্ধটা কি এড়ানো যেত না। ইন্টারনেটে হিংস্রতার যেসব ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, তাতে নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য হয়েছি, আমরা কি চাঁদে পৌঁছে যাওয়ার মতো সভ্য হয়ে উঠেছি!! রক্তমাংসের মানুষগুলোকে মারছে, তারই মত আরেকটা প্রাণী। কি পৈচাশিক আনন্দ – উন্মাদনা। উফফ ভাবতেই গা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে। এটাই কি তাহলে ‘ এআই ” যুগের আধুনিকতা।
বছর যেতে যেতে গণতন্ত্রের এক বাজে দিকটা প্রত্যক্ষ করেছে গোটা দেশ। যখন কথা বলার জন্য ভারতীয় গণতন্ত্রের পীঠস্থান বলে বিশ্বে সমাদৃত সংসদ থেকে সাসপেন্ড করা হয় একের পর এক সাংসদকে। প্রায় বিরোধীশূন্য গণতন্ত্রের দেবালয়ে পাশ হয়ে যায় দন্ড সংহিতা হয় বেশকিছু বিল।
বছর যখন ‘ শেষের
‘ স্টেটাস লাগিয়ে দিল তখন পিছন পানে তাকিয়ে আর কিসের লাভ। ভালো স্মৃতি যেমন একচিলতে হাসির খোরাক করে দেয় তেমনি বুকে যন্ত্রণার সঞ্চার করে বাজে স্মৃতিগুলি। বিকৃত করে আগাম ভাবনাগুলিকে।
তাই তো নতুন বছরে নতুন ভাষ্য, নতুন রিজোল্যুশন। এই বছরই গণতন্ত্রের বৃহৎ উৎসবে মাতবে গোটা দেশ। যখন মার্চ – এপ্রিলে (পড়ুন সম্ভবত ) আসমুদ্রহিমাচলের দেওয়াল লিখনে লাগবে লোকসভা নির্বাচনের স্টেটাস। কামনা এতটুকুই,বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রর দেশে নির্বাচন যেখানে হবে প্রকৃত অর্থে স্বচ্ছ, দুর্নীতিহীন। যেন এমন না হয়, হেরে গেলে পরে ইভিএম মেশিনের দোষ এবং জিতলে পরে সেই ইভিএম মেশিনই একদম সঠিকরূপে কার্যকর।যেখানে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনী অভিযানে প্রতিদ্বন্দ্বিতার রূপ রাখবে বটে, কিন্তু কোনওভাবেই জাত ও ধর্মের নামে ইতর প্রতিশ্রুতি ও তরজার আশ্রয় নেবে না। যেখানে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনওভাবে জনতাকে উন্মত্ত করার মতো শত্রুতা ও বিরোধের পরিসর তৈরির চেষ্টা করা হয় না এবং তৈরি হলে পরে কঠোরভাবে তা রুখে দেওয়া হয়। তেমনি দেশ জাগ্রত হবে মনিপুরের বর্বরতার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। ধর্ষণ, যৌতুকের বলি, বাল্যবিবাহমুক্ত দেশে নিরাপদ থাকবে আমাদের মেয়েগুলি। ধনী – গরিব, ব্রাম্মন – শূদ্র সবাই একপাতে ভাত খাবে। থাকবে না সাদা কালোর অসমতা। সীমানার কাঁটাতার বিধবে না কোনো পরিযায়ীর শরীরে। এক হবে দেশ এক হবে পৃথিবী। তা ইজরায়েলে সন্ত্রাসী হামলা গাজার জনগণকে নিশ্চিহ্ন করা এবং মানবিক বিপর্যয়কে সমর্থন করবে না। প্রতিশোধমূলক বোমা হামলা আন্তর্জাতিক আইনের নির্লজ্জ লঙ্ঘন হয়ে ওঠবে না। যেখানে একজন নিষ্পাপ প্যালেস্তিনীয় শিশুর জীবন একজন ইজরায়েলি শিশুর জীবনের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠবে। উন্মুক্ত হবে সীমানা, আমরা উড়ব নীলাম্বর জুড়ে। ভালোবাসার ঝিলিকে সরে যাবে ঘেন্নার কুয়াশা। তাই তো এই বছরটায় থাক না ‘ শুধু ভালোলাগা, ভালোবাসা ‘।
সবশেষে এতটাই বলতে পারি ‘ বেশ আছি ভালো আছি ‘। আর চিরাচরিত এই ট্রেনডিং শব্দটা যেন না বললেই হল না – ‘ হ্যাপি নিউ ইয়ার ‘।