মৃত্যুঞ্জয় দাস
বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলামের আগুন ঝরানো গানের বিকৃতি নিয়ে সরগরম নেটদুনিয়া। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশের জেলবন্দিদের সাহস জোগান দেওয়া ও উজ্জীবিত করার রক্তগরম করা শব্দচয়নে লেখা গানের এই পরিণতিতে এআর রহমানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই ব্যাপক ক্ষোভ উগরে দিলেন কবির নাতি কাজি অরিন্দম। প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, ‘আগুন নিয়ে খেলছেন এ আর রহমান।‘ তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলে দু’দিন আগে আপলোড করা হয় একটি গান। সেই গান নিয়েই তোলপাড় সারা বিশ্বের বাঙালি। কবি নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লোহ কপাট/ ভেঙে ফেল কররে লোপাট/ রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণবেদী’-কে ভারতের জনপ্রিয় সঙ্গীতকার যেভাবে নিজের আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন সে নিয়েই ক্ষুব্ধ দুই বাংলা ছাড়াও বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অগণন বাংলাভাষী। প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক মাধ্যমে নিন্দার ঝড়। তীব্র সমালোচনাও চলছে রহমানের এই উপস্থাপন নিয়ে। সরাসরি অভিযোগ করা হচ্ছে, বাঙালির আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন এআর রহমান।
গানের শিল্পীরা বাঙালি। তাঁরা হলেন তীর্থ ভট্টাচার্য, রাহুল দত্ত, শালিনী মুখোপাধ্যায়। তাদের মতো গায়ক যখন গানটিকে বিকৃত করে গেয়েছেন বলে সমালোচনা হচ্ছে তাঁদের ঘিরেও। প্রশ্ন উঠছে, বাঙ্গালির বিদ্রোহী সত্ত্বায় শান দেওয়া নজরুলের এই গানটি গাইতে গিয়ে তাঁদেরও কি একবারের জন্যও খটকা লাগেনি ? এই প্রশ্ন তুলছেন সঙ্গীতপ্রেমীরা। রাহুল, তীর্থ ও আর এক গায়ক পীযূষ দাশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও দেখা যায়, রাহুলের ফোন সুইচড অফ। একাধিক বার ফোন করা হলেও কল রিসিভ করেননি পীযূষ ও রাহুল। প্রশ্নের সম্মুখীন না হতে অথবা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে তাঁরা মোবাইল তোলেননি বলে অভিযোগ। ইংরেজ শাসকদের অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুলের কলম গর্জে উঠেছিল, আহবান জানিয়েছেলেন জেগে ওঠার, ব্রিটিশের কারাগারগুলোর তালা লাথি মেরে ভেঙে ফেলার। কিন্তু রহমানের রিমেক ভুলে গিয়েছে সেই সব আগুন ঝরানো প্রতিবাদের কথা, বুঝে উঠতেই পারেনি নির্মম দহনের অব্যক্ত অনুভূতি। এই অভিযোগে সরব বিভিন্ন মহল।
এদিকে, যেভাবে নিজের আঙ্গিকে রহমান যেভাবে গানটি উপস্থাপন করেছেন, তা শুনে ক্ষোভ ও প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে নজরুলের পরিবারও। পারিবারিক সম্পর্কে নজরুল ইসলামের নাতি কাজি অরিন্দম শুক্রবার প্রচারমাধ্যমের কাছে জানান, ‘দাদু বলতেন, ‘যদি আমার কবিতায় আমাকে কেউ মনে না-ও রাখেন, অন্তত গানে মনে রাখবেন’। দেশের কঠিন সময়ে নজরুলের কলম হয়ে উঠেছিল তাঁর অস্ত্র। সেই গানকেই অপমানে ক্ষুব্ধ অরিন্দম বলেন, আমার দাদু এমন এক ব্যক্তিত্ব, তাঁকে বিশ্বেবাসীর কাছে আলাদা করে পৌঁছে দেওয়ার খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আজকের উঠতি প্রজন্ম তাঁকে নিয়ে চর্চা না করলে সেটা তাদের দুর্ভাগ্য। তাঁর এমন অনেক গান আছে, যা বৃহত্তর বাঙালি শুনে বড় হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে দাদু এরকম অনেক গান লিখেছেন। কে না জানে তাঁর কালজয়ী ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’-র মতো রচনার কথা। সেই পর্যায়েই লেখা বিদ্রোহের গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’।
এআর রহমানের মেধা ও প্রতিভা নিয়ে তাঁর কোনও দ্বিধা নেই। তিনি একজন বড় মাপের সঙ্গীতকার, নির্দেশক। ‘দু’দিন আগে হঠাৎদেখলাম রহমান সাহেব ওই গানটির সুরই বদলে দিলেন!’ এতে অবাক হয়ে যান অরিন্দম। হতবাক হয়ে যান তিনি। রহমানের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে বলেন, গানটি উপস্থাপনের আগে কারও সঙ্গে কথা বলেছিলেন টিনি? সুর পরিবর্তন করে কী বোঝাতে চাইলেন তিনি?’ একটা বহুশ্রুত সুর, বহুকাল আগের একটা গান কোন অধিকারে তিনি বদলে দিতে পারেন? এই প্রশ্ন নজরুল পরিবারের। কাজি অরিন্দম বলেন,’আমরা অবশ্যই চাই, দাদুর গান ছড়িয়ে পড়ুক, কিন্তু এইভাবে? নজরুল ইসলামের গান শুরু থেকেই আধুনিক, তাই তাঁকে রি-অ্যারেঞ্জ বা মডিফাই করার অর্থ হয় না। ‘আমি তা মানি না‘ , তাঁর সোজাসাপ্টা জবাব। বলেন,’যে সংস্কৃতি বাঙালি ছোটবেলা থেকে লালন করেছে, সেই সংস্কৃতিরও মূল্য থাকল না বলেই মনে করি আমি।‘ গানের বাণী উধ্রিত করে আবেগজড়ানো গলায় বলেন, ‘ওরে ও পাগলা ভোলা/ দে রে দে প্রলয় দোলা / গারদগুলা জোরসে ধরে হ্যাঁচকা টানে/ মার হাঁক হায়দারী হাঁক/ কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক/ ডাক ওরে ডাক, মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে’। এখনও বিশ্বজুড় যে হানাহানি, সেখানে তো এই গানের প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। এটি একটি আহ্বানের গান। অশুভ শক্তির বিনাশের ডাক দেওয়া হয়েছে এতে। ‘গানের প্রতিটি শব্দবন্ধে রয়েছে প্রতিবাদের সুর, বিপ্লবের আহ্বান। এরকম একটা গান নিয়ে যা হয়েছে, তা নেহাত ‘আগুন নিয়ে খেলা’।বলেন কাজি অরিন্দম।
এই গান নিয়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে বরাক উপত্যকায়ও। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা সভাপতি সঞ্জীব দেব লস্কর বলেন, ’কারার ঐ লৌহ কপাট’ কথা অপরিবর্তিত, কিন্তু সুর পরিবর্তিত। বাংলা উচ্চারণও ঠিক নয়। সত্যিই এআর রহমান আমাদের প্রিয় কবি নজরুল ইসলামের এ গানটির আত্মাকে নষ্ট করেছেন। ১৯২১ সালে রচিত বাংলার অন্যতম বিদ্রোহের গানের এ রূপান্তর বাঙালিকে আহত করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে তো বটেই, এর পরবর্তী দিনগুলোতেও এপার বাংলা, ওপার বাংলা সর্বত্রই গানটি বাঙালিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ‘লাথি মার ভাঙ রে তালা/ যত সব বন্দিশালায় আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা’– একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার এবং আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এ পঙক্তিগুলো আমাদের আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে মাসের পর মাস। সেই থেকে এ সুর আমাদের প্রজন্মের প্রাণে গেঁথে আছে। গানের কথা তো বটেই, এর সুরও আমাদের অনুপ্রেরণা। আমি সেই সাবেক সুরেই গানটি শুনে যাব সব সময়। শুনতেও চাই ওই একই সুরে।
শিলচরের নজরুল মঞ্চ প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, আমাদের প্রাণের কবি কাজি নজরুল ইসলামের কালজয়ী সৃষ্টি ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি নিয়ে এআর রহমানের নতুন করে সুরারোপিত গানটি শুনলাম। অবাক হলাম ওনার মতো একজন বিখ্যাত সঙ্গীতস্রষ্টার এহেন মস্তিষ্কবিকৃতি দেখে। যদিও এটা ওনার প্রথম কাজ নয়, এর আগেও কবিগুরুর ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ গানটিকেও একইভাবে বিকৃত করেছেন। এধরণের বিকৃত মানসিকতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। কবির রচনাকে নিয়ে কোনও কিছু করার আগে উনি গানটি রচনার প্রেক্ষাপট ও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লক্ষকোটি মানুষের ভাবাবেগের প্রতি অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল ও যত্নবান হওয়া উচিত ছিল রহমানের। কালজয়ী দেশাত্মবোধক সঙ্গীত, যা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মনে আগুন ঝরিয়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল, এসব নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার আগে আমাদেরও অনেক বেশী যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। আজকের এই মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের যুগে দাঁড়িয়ে এআর রহমানের মতো সঙ্গীতশিল্পীদের সামাজিক দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আমি আরও বেশি আহত হয়েছি, যখন দেখলাম একজন অবাঙালি সঙ্গীত পরিচালক সুরারোপিত গানটিতে কয়েকজন বঙ্গ-সন্তান কণ্ঠ দিয়েছেন! আমি আবারও এ ধরনের কাজের নিন্দা জানিয়ে এই গানটি রিলিজ না করার আহ্বান জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য, ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে কুমিল্লা থেকে কলকাতা আসার পর ঝুমুর তালের ওপর কাজি নজরুল লেখেন এই অবস্ম্রণীয় এই ‘ভাঙার গান’।ব্রিটিশ শাসক গানটি নিষিদ্ধ করে।সে বছরই তিনি লেখেন আরও দুটি কালজয়ী বিপ্লবের কবিতা ‘কামালপাশা’ ও ‘বিদ্রোহী’। কাজি নজরুলের স্পর্ধিত লেখনীতে উজ্জীবিত হয় ইংরেজ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তিকামী বাঙালি। তবে এই গান নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ায় নয়া প্রজন্মের মধ্যে গানটি শোনা এবং বাণী পড়ার ধুম লেগেছে। এটাই আশার কথা।