অনলাইন ডেস্ক : ‘ধর্মই আমাদের পরিচয়, নিজেরা সংঘবদ্ধ না থাকায় ১৯৪৭ সালের পর নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে শিয়াল-কুকুরের মত পালিয়ে আসতে হয়েছিল। এবারও যদি হিন্দুরা সঙ্ঘবদ্ধ না হয় নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় এর প্রতি উদাসীন থাকে তাহলে একদিন এদেশেও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে,’ এমনটাই বললেন ভারত সেবাশ্রমের পশ্চিমবঙ্গের বেলডাঙ্গা হিন্দু মিলন মন্দিরের অধ্যক্ষ পদ্মশ্রী প্রদীপ্তানন্দ (কার্তিক) মহারাজ। শিলচরের হিন্দু মিলন মন্দির প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে রবিবার শিলচরে এক প্রকাশ্য সভা আয়োজন করে ভারত সেবাশ্রম সংঘ। এতে মুখ্য বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কার্তিক মহারাজ। তিনি পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতবর্ষ এবং গোটা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভারত সেবাশ্রম সংঘের আদর্শ প্রচার করেছেন। তার সমাজসেবামূলক কাজের জন্য ভারত সরকার পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করেছে। রবিবার বিকেলে চিত্তরঞ্জন এভিনিউ সংলগ্ন এসটিসি বাসস্ট্যান্ডে প্রকাশ্য সভায় প্রায় হাজার খানেক শ্রোতা অংশ নেন। কার্তিক মহারাজের সঙ্গে এদিন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ভারত সেবাশ্রম সংঘের ফিজি শাখার অধ্যক্ষ সংযুক্তানন্দ মহারাজ, সংঘের উত্তর-পূর্বের দায়িত্বে থাকা সাধনানন্দ মহারাজ, শিলচর হিন্দু মিলন মন্দিরের পক্ষ থেকে গুণসিন্ধু মহারাজ, শিলচরের বিধায়ক দীপায়ন চক্রবর্তী, উধারবন্দের বিধায়ক মিহির কান্তি সোম, উত্তর করিমগঞ্জের বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ সহ অন্যান্যরা। কার্তিক মহারাজ বলেন, বাঙালিরা শ্রীকৃষ্ণকে মাখনচোর, রাসসিলায় মত্ত প্রেমিক এবং স্নান করতে থাকা মহিলার কাপড় চুরি করা বালক হিসেবে দেখেছে। অথচ সেই শ্রীকৃষ্ণ জন্মের পর পুতনা রাক্ষসীকে বধ করেছিলেন, ১১ বছর বয়সে কংসবধ করতে যাওয়ার সময় মত্ত হাতিকে এক লাথি মেরে শেষ করেছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয় করতে পান্ডবদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে শ্রীমদ্ভগবত গীতা রচনা করেছিলেন। গীতার আদর্শ কখনো বলে না হাত তুলে হরিনাম জপ করো, সেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন “পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্”। ধর্মসংস্থাপের জন্য তিনি বিনাশকারী রূপ নেওয়ার কথা বলছেন। আমাদের আদর্শ শ্রীকৃষ্ণকে ওই রূপে দেখে। আমি বৈষ্ণবদের প্রশ্ন করছি, কোথায় কৃষ্ণ বলেছেন শুধুমাত্র হাত তুলে হরিনাম জপ করতে? কাল্পনিক রাধার প্রসঙ্গ এনে বাংলার একটা অংশ কৃষ্ণের বীরপুরুষ আদর্শ ভুলে গিয়ে নপুংসক হয়েছে। এই নপুংসকতাই আমাদের ধ্বংসের অন্যতম কারণ। বৈষ্ণবরা চৈতন্য মহাপ্রভুকে একটা মেয়েলি চোখে দেখেন। অথচ চৈতন্য মহাপ্রভু একজন বলিষ্ঠ পুরুষ ছিলেন। প্রায় সাড়ে ছয় ফুট উঁচু বলিষ্ঠ পুরুষ শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু একসময় বলেছেন “ধর কাজী মার কাজী”। সেই আদর্শকে সরিয়ে নপুংসকতার চর্চা করতে গিয়ে আমরা ভুলে গেছি হিন্দুরা কতটুকু বলিষ্ঠ। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, হিন্দু ভারতের প্রাণ এবং মুসলমান হচ্ছে নয়নের মনি। একটা লোক চোখ ছাড়াও বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু প্রাণ গেলে চোখ সহ গোটা দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। আমরা ভারতের প্রাণকে রক্ষা করতে চাই, আমাদের আদর্শ শ্রীরামচন্দ্র। তিনি দৈবশক্তিতে রাবনকে নিমিষে শেষ করে সীতা উদ্ধার করতে পারতেন। সেটা না করে ধনুক হাতে যুদ্ধ করেছেন। প্রকৃতির প্রত্যেক সৃষ্টিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কাজটি করেছেন। এর মাধ্যমে আমাদের একটা আদর্শ দিয়ে গেছেন। আমাদের আত্মসম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব নিজেদের।
এদিন প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমেই সাধনানন্দজি মহারাজ ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য শ্রীমৎ স্বামী প্রণবানন্দের জীবনাদর্শ এবং এই সংগঠন গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘গুরু মহারাজ বলেছেন হিন্দুত্বই ভারতীয়ত্ব। হিন্দুরা ভারতবর্ষকে যতটা ভালবাসে আর অন্য কোন ধর্মের লোকের দ্বারা সম্ভব নয় এবং তাদের আদর্শেও সেটা নেই। গুরু মহারাজ চেয়েছিলেন, যেভাবে মুসলমানদের মসজিদ এবং খ্রিস্টানদের গির্জা রয়েছে, হিন্দুদের একত্র হওয়ার জন্য একটা মন্দির থাকুক। সেই মন্দিরে শুধু পুজো নয়, হিন্দুদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো হবে, হিন্দু রক্ষী দল গড়ে তোলা হবে। আত্মসম্মানবোধ নিয়ে শিক্ষা প্রদান করা হবে। আজ ভারতের প্রতিটি রাজ্যে প্রায় প্রতিটি শহরে এধরনের মন্দির রয়েছে। হিন্দু ধর্মে আমরা মা কালী, শিব, রামচন্দ্র এবং শ্রীকৃষ্ণ, প্রত্যেকটি দেখেছি অস্ত্র হাতে শত্রু দমন করতে। যে সম্প্রদায় তাদের পুজো করে তারা দুর্বল হতে পারে না।’সংযুক্তানন্দ মহারাজ বলেন, ‘এই সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন একটি নিমিত্ত মাত্র। আমাদের উদ্দেশ্য প্রত্যেক হিন্দুকে একমঞ্চে আনা। প্রত্যেক হিন্দুকে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে গুরু মহারাজ এই সংগঠন গড়েছিলেন। হিন্দুরা অসংগঠিত থাকায় অতীতেও তাদের ঠকানো হয়েছে, এখনো এই ধারা অব্যাহত। ভারতে আমরা যাদের দুর্বল বলে আশ্রয় দিয়েছিলাম তারা এখন আমাদের পরিবারের মহিলাদের উপর কুনজর দিচ্ছে এবং আমাদের সম্পত্তি লুট করছে। একটি বোর্ড বানিয়ে ভারতবর্ষের লক্ষ-কোটি বিঘা জমি দখল করে রেখেছে ওরা। ভারতবর্ষের ইতিহাস ঘাটলে একটা বিষয়ে চোখে পড়ে, হিন্দুরা যেখানে আত্মরক্ষার জন্য একত্র হয়নি, সেখানেই আমাদের জন্য পতন হয়েছে। সোমনাথ মন্দির একসময় বিশ্বের সবথেকে ধনী মন্দির ছিল। যখন বিদেশীরা ওই মন্দিরে আক্রমণ করে, পনেরশো পুরোহিত ঈশ্বর রক্ষা করবেন বলে অপেক্ষা করেন। বিদেশীরা মন্দির লুণ্ঠন করে সব সম্পত্তি নিজের দেশে নিয়ে যায়। সেখানে একটা মসজিদ বানানো হয় এবং প্রত্যেক সিঁড়িতে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি রাখা হয়। যারা ওই মসজিদে যায় তারা দেবদেবীর মূর্তির উপর পা রেখে যায়। তারা এমনটাই করবে, এটা তাদের স্বভাব। আমরা যদি নিজেদের আত্মরক্ষার্থে অস্ত্র তুলতে না পারি তাহলে এমনটাই ঘটতে থাকবে।’বিধায়ক দীপায়ন চক্রবর্তী বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন হিন্দু বাঁচলে ভারত বাঁচবে আর ভারত বাঁচলে বিশ্ব বাঁচবে। তার নেতৃত্বে দেশে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, এখন ভারতবর্ষে হিন্দুরা গর্বের সাথে নিজেদের হিন্দু বলেন। ভারত সেবাশ্রম সংঘের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা এই ধারণাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছি।’ এদিন প্রকাশ্য সভার শেষে গুরু মহারাজের পুজো, আরতি এবং প্রসাদ বিতরণের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ হয়।