ইতিহাসের দর্পণে উধারবন্দ এবং কাছাড়
চারু যোশী ও পিনাক কান্তি রায়
কোন একটি স্থানের নেপথ্যে লুকিয়ে থাকে অতীতের অনেক জানা অজানা গল্প, কিংবদন্তী ও বাস্তবের মিশেল।
কাছাড়ের প্রান্তিক ভূমি উধারবন্দ ও তার আশপাশের অঞ্চল জুড়ে রয়েছে এমনই কিছু কাহিনী– যার অনেকটাই জুড়ে রয়েছে ‘ হাইডিম্বাদেশ ‘ জাতির অস্তিত্ব, কৃষ্টি -সংস্কৃতি। এই জাতির সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শ রয়েছে মহাকাব্য মহাভারতের। ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী, বনবাসকালে পান্ডবরা আত্মগোপনে এসেছিলেন এই অঞ্চলটায়। পরবর্তীতে ‘হাইডিম্বা’ রাক্ষসকূলের রাজকুমারী হিড়িম্বার সঙ্গে মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গিয়েছিল পান্ডু পুত্র মহাবলী ভীমের। গন্ধর্ভ মতে হিড়িম্বাকে বিয়েও করেছিলেন তিনি। তাঁদের ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে মায়ালোকে আবির্ভাব হয়েছিল মহাভারতের অন্যতম অনন্য চরিত্র মহাশক্তিশালী ঘটতকচের। মহাভারতের যুদ্ধে কৌরবদের চক্ষুশুল হয়ে উঠেছিলেন এই ভীমপুত্র। শেষঅবধি শক্তিশেল অস্ত্র প্রয়োগ করে ঘটতকচকে শেষ করে নিজের ‘শেষেরও’ আবাহন করেছিলেন কৌরবদের ধনুক হাতে শ্রেষ্ঠ শিল্পী কর্ণ। আরও অনেক গল্প জুড়ে রয়েছে এই জাতি, এই অঞ্চলকে ঘিরে। হিড়িম্বার বংশধরেরা অনেক বছর কাছাড়ে শাসন করেছে। তারাই এই অঞ্চলটার নামকরণ ‘কাছাড় ‘ করেছিলেন। তবে অনেকের দাবি, কাছাড় অঞ্চলটা মূলত বাংলাদেশের সিলেটের অংশ ছিল। সেই অঞ্চলের লোকদের ভাষা সংস্কৃতি এই এলাকার সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। তবে ডিমাসারা এই দাবি বারংবার প্রত্যাখ্যানই করেছে।
ডিমাপুর জুড়েই শুরুর দিকে ছিল হাইডিম্বাদের সাম্রাজ্য। ১৬ শতকের মাঝামাঝিতে সাম্রাজ্য বিস্তারের অভিলাষে উত্তর কাছাড়ের দিকে চোখ পড়ে কাছাড়িদের। মাইবংকে রাজধানী করে তাঁদের শাসনের সূত্রপাত হয়। অবশ্য হাইডিম্বাদের শাসনের শুরুতেই বিপত্তি বাসা বাঁধে। ১৭০৬ সালে ডিমাসা রাজা তাম্রধ্বজ এর উপর হামলা চালান তৎকালীন আহোম রাজা রূদ্র সিংহ। আহোমদের বিশাল সেনা এবং প্রবল পরাক্রমের সামনে তাম্রধ্বজের প্রতিরোধের বাঁধ ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে পাশের জয়ন্তীয়া পাহাড়ে আশ্রয় নেন তাম্রধ্বজ।কিন্তু আহোমদের আতঙ্কে তাম্রধ্বজকে আশ্রয় দেওয়ার দুঃসাহস আর দেখাতে পারেননি জয়ন্তীয়া রাজা। তখন বিকল্পহীন তাম্রধ্বজ আত্মসমর্পণ করেন আহোম রাজা রূদ্র সিংহের কাছে। পরবর্তীতে পাহাড় থেকে বিতাড়ণ করে সমতল কাছাড়ের উত্তর দিকে তাম্রধ্বজকে পাঠিয়ে দেন আহোম রাজা। সেখানে তিনি অনুগামীদের নিয়ে ফের শাসন শুরু করেন। রাজধানী ছিল খাসপুর। পরে ব্রাহ্মণদের পাশাপাশি নতুন এই রাজ্যটায় কাজের সন্ধানে আসেন কোচবিহারি, ত্রিপ্রা ( ত্রিপুরা), বাঙালি, সিলেটিরা।
উধারবন্দের ইতিহাস : কাছাড়ি রাজাদের মধ্যে এতদ্অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র নারায়ণ। ১৮১৩ থেকে ১৮৩০, কাছাড়ের শাসকের মুকুটটা ছিল কৃষ্ণচন্দ্রের মাথায়। এই সময়টায় তিনি ‘অভিনব ‘ একটা কর ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন। ‘উধা’ অর্থাৎ উপাধি দেওয়ার নামে বিত্তবানদের কাছ থেকে রাজার লোকেরা কর আদায় করত। আর তা ‘ভেট’ চড়ানো হত ডিমাসাদের পূজিত দেবী ‘কাসৌদি মাদাই ‘-র চরণে। তখন রাজার আদেশে ডিমাসা সহ অন্যান্য জাতির লোকদের এই দেবীর পূজার্চ্চনা করাটা বাধ্যতামূলক ছিল। আর বিত্তবানদের কাছ থেকে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা আদায় করা হত। আর বিনিময়ে চৌধুরী, লস্কর, মজুমদার, বড়লস্কর ইত্যাদি ‘উধা’ অর্থাৎ উপাধি দেওয়া হত সেইসব করদাতাদের। যেহেতু ‘উধা’ দেওয়া হত লোকদের তাই পুরো অঞ্চলটার নামই পরে যায় উধারবন্দ। ডিমাসা ভাষায় কাসৌদি মাদাই- র মানে হল দয়াময়ী মা। ভাবভক্তিতে কোনো কার্পণ্য না থাকলেও ডিমাসা ব্যতিত অন্যান্য জাতির লোকদের এই নাম উচ্চারণে (মত ইতিহাসবিদদের ) অনেকটাই অসুবিধা হত। তাই আরাধ্য দেবীকে তারা অন্য নামে ডাকতে শুরু করেন । এই কাসৌদি মাদাই দেবীই হলেন মা কাঁচাকান্তি। শুধু উধারবন্দ নয় এই মা কাঁচাকান্তির পুজো দিতে অনেক দূরদূরান্ত থেকেও ভক্তরা আসেন।
(ক্রমশ)