অনলাইন ডেস্ক : অফিসের নিজস্ব ড্রয়ার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাপিস হয়ে যাওয়ার পর এবার পরের জায়গাজমি কব্জা করে নেওয়ার মতো প্রতারণা মামলায় নাম উঠে আসছে খোদ সাব রেজিস্ট্রার অফিসের বড়বাবুর। সম্প্রতি শিলচর সাব রেজিস্ট্রার অফিসের বড়বাবুর ড্রয়ার থেকে নগদ তিন লক্ষ টাকা গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হলে উল্টো ল্যাজেগোবরে হতে হয় তাকে। খবরটি চাউর হতেই সন্দেহের তির তার দিকেই বর্ষিত হয়। সেই ‘হারানো’ টাকার ঘটনা তাজা থাকতেই এবার সেই রহস্যময় করণিক রামনগরের আব্দুল জলিল মাঝারভুইয়ার বিরুদ্ধে প্রতারণা করে এক মহিলার জমি হড়পের মারাত্মক অভিযোগ উঠল। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি কোর্টে পারবিন সুলতানা মাঝারভুইয়া আবেদন জানালে শিলচর সদর থানার ওসিকে মামলা নথিভুক্ত করে তদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশের কড়া নির্দেশ দেন শিলচরের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ( ফার্স্ট ক্লাস) শিখা বর্মণ। এরপর পুলিশ সদর থানায় জলিলের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০/৪০৬/৪৬৮/৪৭১/৫০৬ ধারায় মামলা ( নম্বর : ১৪৩/২০২৩ ) রুজু করা হয়। যে মহিলার জমি আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠছে, সেই মহিলা পারবিন সুলতানা মাঝারভুইয়া অভিযুক্ত জলিলের সম্পর্কিত আত্মীয়।
ঘটনার খবর নিয়ে জানা যায়,পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের শিলচর শাখায় রামনগরের নিজস্ব জমি মর্টগেজ রেখে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে স্বামীর নামে একটি লোন নেন পারবিন।২০২২ সালের প্রথম দিকে ওই জমিতে একটি দোকানঘর নির্মাণের কাজে টাকার প্রয়োজন পড়ায় পারিবারিক আত্মীয়তার সুবাদে পারবিন সুলতানার স্বামীকে আগ বাড়িয়েই দফায় দফায় মোট ৩ লক্ষ টাকা ধার দেন জলিল।সে বছর মে মাসের শেষের দিকে একদিন রাতে আচমকা পারবিনের ঘরে এসে স্টাম্প পেপার সাঁটা সাদা কাগজে ওই টাকার প্রমান রাখার নাম করে স্বামী-স্ত্রী উভয়কে সই দিতে বলেন জলিল। কিন্তু এটাই যে তাদের কাল, তা ঠাহর করতে পারেন নি পারবিন ও স্বামী। ধার করা টাকা শোধ হলে সেই দস্তাবেজ ফেরত দেবেন বলে বুঝিয়ে সই আদায় করে নেন আব্দুল জলিল মাঝারভুইয়া। বলা বাহুল্য, সাব রেজিস্ট্রার অফিসের বড়বাবু হওয়ার সুবাদে জায়গাজমি সম্পর্কিত বিষয়আশয় ও প্যাঁচপয়জার জলিলের কাছে সহজসরল। এরমধ্যে সরলমনা দম্পতিটির ছিল তার ওপর অগাধ বিশ্বাস। তাই কৌশলে স্টাম্প পেপারে সই আদায় করে জমি হড়পের মতলব তারা বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেন নি বলে মামলায় উল্লেখ করেন পারবিন।
এই ঘটনার পর চলতি বছর ১৩ জানুয়ারি সেই লোনের টাকা শোধ করতে অভাবগ্রস্ত পারবিন ও তার স্বামীর পাশে ফের স্বেচ্ছায় দাঁড়ান জলিল। ধীরে ধীরে পারবিনের জমি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি এবারও যে জলিল আরেকটা চাল চালাতে এসেছেন, তা কল্পনাও করতে পারেন দম্পতিটি। যা হোক, জলিল নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে ১লক্ষ ৬০ হাজার টাকা ধার দেন তাদের। গত ১৫ জানুয়ারি পুরনো কৌশল অবলম্বন করে ফের আরেকটি সাদা স্টাম্প পেপারে ওই টাকা ধার করার প্রমাণস্বরূপ স্বামী-স্ত্রীর সই আদায় করে নেন। এরপর গত ৩ এপ্রিল ব্যাঙ্কে বন্ধক থাকা জমির দলিল ও আনুষঙ্গিক নথিপত্র ফেরত নিয়ে আসেন পারবিন। এদিকে, ব্যাঙ্ক থেকে আসতে না আসতেই লোকমুখে প্রচার চালাতে থাকেন যে, ওই দলিলে যে পরিমাণ জমি রয়েছে সেখান থেকে ২ কাঠা জমি নাকি কিনে নিয়েছেন জলিল। বিষয়টি শুনেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে পারবিন ও তার স্বামীর। কাকুতিমিনতি করে বিস্তারিত ঘটনা জানতে চাইলে অভিযুক্ত আব্দুল জলিল মাঝারভুইয়া কোনও সদুত্তর না দিয়ে উল্টো ভয় দেখিয়ে সরাসরি তাদের ঘর ভেঙে জমি খালি করার হুমকি দেন। প্রতিবাদ করতে গেলে হিংসাত্মক আচরণও করেন তিনি। নিরুপায় হয়ে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে জমিটির কোনও দলিলের সন্ধান পাওয়া যায় কিনা, তা খোঁজ করেন পারবিন ও তার স্বামী। এই সুযোগে গত ৯ এপ্রিল দলবল নিয়ে সেই জমির ওপর পারবিনদের ঘর ভেঙে জবরদখল করার প্রয়াস চালালে পুলিশের হস্তক্ষেপে সে যাত্রা রক্ষা পায়। এরপরেও বদ উদ্যেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়ে পারবিনের পরিবারের ওপর হুমকি ছাড়াও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা চালিয়ে যান বলে অভিযোগ তোলেন জলিলের বিরুদ্ধে।
এদিকে, বহু চেষ্টা করে শিলচরের সিনিয়র সাব রেজিস্ট্রার অফিস থেকে গত ৩ জুন অন্যায় ভাবে সম্পাদিত ওই জমির ভুয়ো দলিল (১৫৬০)-র নকল কপি বের করে পারবিনরা জানতে পারেন, জেলাশাসকের কার্যালয় ও শিলচর ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অফিস থেকে পারবিনের নামে ওই জমির ওপর এনওসি বের করে স্বাক্ষরিত কাগজ দিয়ে সেই জমিখণ্ডের বাসগৃহ সহ ২ কাঠা জমি নিজের নামে কিনে নেওয়ার দলিল বানিয়ে এক বড়সড় জমি কেলেঙ্কারি করেন জলিল। তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে পারবিনের পরিবার এখন অথৈ জলে হাবুডুবু খাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, জালিয়াতি করে অন্যের জমি নিজের নামে বাগিয়ে নেওয়ার পর কূটকৌশল অবলম্বন করে সরকারি চাকরিজীবী নিজের স্ত্রী আলেয়া বেগম মাঝারভুইয়ার নামে ২০২৩-এর ক্রমিক নং- ৮৯৭-এর ৮৬ নং দলিলে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে দেন জলিল। শিলচর শহরতলি এলাকায় একজন সরকারি কর্মচারীর এভাবে সরাসরি জমি কেলেঙ্কারি ও অন্যের জমি বেদখল করার ঘটনা নিয়ে চাপা গুঞ্জন বেশ কিছুদিন ধরে চলছে। তারপর নিজের দফতরের ড্রয়ার থেকে একই ব্যক্তির ৩ লক্ষ টাকা গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনার আড়ালে বিশাল রহস্যের আঁচ পাচ্ছেন অনেকেই। কেউ কেউ দুটো ঘটনাকে একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। এর একটা বাস্তব কারণও রয়েছে। কেননা, জমি বাগিয়ে নেওয়া বা বেদখল করার সঙ্গে টাকার অঙ্কও তিন লক্ষ। অফিসের ড্রয়ার থেকে হাপিশ হয়ে যাওয়া টাকার হদিশ এখনও না পেলেও সন্দেহের তির জলিলের দিকেই রয়েছে। এবার জমি আত্মসাতের অভিযোগে ফাঁসতে যাচ্ছেন কিনা, সেটা সময়ই বলবে।