উত্তমকুমার সী
‘অনেক পাগলও সুস্থ হয়ে গেছে এ বন্যায়,
ভিক্ষুকের মুখে মৃদু হাসি
এক কাতারে দাঁড়িয়েছে সব
আশ্রয় শিবিরে কোনও স্তর নেই
সব বানভাসি।
খাদ্য চাই, পানি চাই, সব রিক্ত
হারিয়ে সম্বল
বাবু বিবি ছুটে আসে জল ভেঙে
যদি পায় একটি বোতল,
সব আছে কিছু নেই ওষ্ঠাগত প্রাণ
আকাশে তাকিয়ে রয় যদি ঝরে
ত্রাণ।
জল নেই জল চাই চারদিকে জল
পথের ভিক্ষুক আর প্রাসাদ নিবাসী
সবাই দাঁড়িয়ে আজ এক সমতল।’
–অতীন দাশ
(বাইশের বন্যায় সামাজিক মাধ্যমে লেখা কবিতা।)
স্বাধীনতার পর বরাক উপত্যকা বেশ কয়েকবার ভয়াবহ বন্যার সাক্ষী হয়েছে। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল ১৯৬৬, ১৯৮৫ এবং ২০২২ সালের জুন মাসের বন্যা। এ ছাড়াও প্রতি বছরই বর্ষা মরশুমে উপত্যকার নিচু এলাকা প্লাবিত হয়। তাই কৃত্রিম হোক বা স্বাভাবিক, বন্যা এখানকার মানুষের কাছে অনেকটাই গা-সওয়া ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ২০২২ সালের জুনের বন্যা কিন্তু এসব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে, এই ১৮ জুন প্রবল জলভারে ফুলে ফেঁপে ওঠা বরাক নদী বিকট শব্দে দুর্বল ও ভাঙা বাঁধ গলিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শিলচর শহরে মহাপ্লাবন ঘটায়। শহরের বেশিরভাগ অংশ সেই কাদামাখা শীতল জলে ডুবে যায়। সেই জুনের প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে শুধু শিলচর শহরই নয়, পুরো উপত্যকা এমনকি গোটা রাজ্যকে ভয়ানক বন্যায় প্লাবিত করে। এই বন্যা এমন আকস্মিক ছিল যে মানুষকে সামান্যতম প্রস্তুতি নেওয়ারও সময়টুকু দেয়নি। মুখ্যমন্ত্রী তখন শিলচর সফরে এসে সেই বন্যাকে ‘মনুষ্যসৃষ্ট’ বা ‘ম্যান মেড’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিছু দুষ্কৃতী শহরতলি বেতুকান্দি-বেরেঙ্গার কাড়ারপার এলাকায় বরাক নদীর বাঁধ কেটে ফেলায় নদীর জল সরাসরি প্রবেশ করে গোটা শিলচর শহরকে প্লাবিত করেছে বলে প্রশাসনের তরফেও ঘোষণা করা হয়। বন্যা পরবর্তী সময়ে সিআইডি দল শিলচর এসে বাঁধ কাটার ঘটনার তদন্তক্রমে মোট পাঁচ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে জল সম্পদ বিভাগের ঠিকাদার যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন শাসক দলের এক কর্মীও। বাঁধ কাটার রহস্য নিয়ে শাসক দলের মধ্যে তুমুল রাজনীতিও হয়। এরকম পরিস্থিতিতেই দিন কয়েকের মাথায় বাঁধ-কাণ্ডে ধৃত পাঁচজনকেই জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। কারণ, ধৃতদের বিরুদ্ধে কোনও তথ্য-প্রমাণ আদালতে পেশ করতে পারেনি কাছাড় পুলিশ এবং সিআইডি। পরবর্তী অধ্যায় এখনও প্রকাশ্যে আসেনি।
আসলে বন্যা ও ভূমিধসের সমস্যার জন্য মানুষই দায়ী। আমাদের সীমাহীন লোভ, উন্নয়নের অজুহাতে সবুজ ধ্বংস করা, পাহাড় ও টিলাভূমি কেটে যেখানে সেখানে বাড়ি-ঘর তৈরি করার ফলে চারদিকে ভূমিস্খলন ঘটছে প্রতিনিয়ত। এতে প্রতি বছর বহু লোকের প্রাণহানি ঘটছে। প্রশাসনের অকর্মণ্যতার জন্য এখনও পর্যন্ত রাজ্যের কোথাও মাস্টার ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে ওঠেনি। প্রতিটি শহরের ছোট বড় নালা ও খালগুলির তীরবর্তী এলাকা জবরদখল করে বাড়ি নির্মাণ, জঞ্জাল নিষ্কাশন ব্যবস্থার অপ্রতুলতায় এবং মানুষের বদভ্যাসের দরুণ রাস্তার পাশে, নালায় আবর্জনা ফেলা—ইত্যাদি কারণে নালা-খালগুলির জল ধারণের ক্ষমতা কমে গিয়ে শহরাঞ্চলকে বার বার প্লাবিত করে ফেলছে।
এক ঘন্টার বৃষ্টিতেই জল জমে আজও শিলচর শহরকে ডুবিয়ে দেয়। প্রতিবছর গুয়াহাটি মহানগরকেও জমা জলে প্লাবিত করছে। এ সমস্যা অনেকদিনের। বৃষ্টির জমা জল নদীতে নিষ্কাশনের জন্য মান্দাতা আমলের যেসব স্লুইস গেট রয়েছে সেগুলিরও ক্ষমতা কমেছে। এতে জল নিষ্কাশনে সমস্যা দেখা দেয়। বারবার প্রয়োজন হয় পাম্পের। একদা শহরের জমা জল নিষ্কাশন হয়ে যেত চারদিকে জলাভূমি থাকায়। ক্রমে সেই নিচু এলাকাগুলিতে জনবসতি গড়ে ওঠায় শহরের জল বেরিয়ে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। সেই আমলের ছোট ছোট বহু স্লুইস গেট আজও রয়েছে, কিন্তু সেসব কতটুকু কাজে আসছে, সেটা অনুসন্ধান সাপেক্ষ। কিন্তু এখন জলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ছোট গেট দিয়ে জল নামতে সময় নিচ্ছে। আবার অতিবৃষ্টিতে খুব কম সময়েই নিচু এলাকা জমা জলে প্লাবিত হয়ে যায়। ফি বছর শিলচর ও গুয়াহাটি শহরে জমা জলের বন্যার কারণও সেটাই। পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী গুয়াহাটির নবীননগর এলাকায় একটি সুবিশাল সরোবর নির্মাণের কথা গত বছরের বন্যার পর ঘোষণা করেছিলেন। মহানগরের কাছাকাছি থাকা প্রাকৃতিক জলাশয়গুলি ধ্বংস করে এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মানুষকে উচ্ছেদ করে সরোবর নির্মাণের মতো পরিকল্পনা গত এক বছরে কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, সেটা জানা যায়নি। তবে এবারও বর্ষা আসার আগেই বারকয়েক গুয়াহাটি শহরবাসীকে জমা জলে হাবুডুবু খেতে হয়েছে।
দুর্বল ইঅ্যান্ডডি বাঁধ এবং নদীর জল নিষ্কাশনে সঠিক চ্যানেল তৈরির ক্ষেত্রে সরকারের চূড়ান্ত গাফিলতি আসামে প্রতি বছর বন্যার অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বন্যা নিয়ন্ত্রণে রাজ্যের বাঁধগুলি সরকারের কাছে অনেকটা কামধেনুর মতো। বিভাগীয় আধিকারিক ও ঠিকাদারদের সম্মিলিত লুটতরাজের ফলে দিনের পর দিন বাঁধের কোনও সংস্কার হয় না, এতে ক্রমশ বাঁধগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই বর্ষাকালে সেই বাঁধ নদীর জল আটকে রাখার ক্ষমতা হারায়। বাঁধ টপকে বা চুইয়ে নদীর জল লোকালয়ে প্রবেশ করে প্লাবন ঘটায়। কোনও কোনও স্থানে নদীর জলস্রোতের ফলে বাঁধে ফাটল দেখা দেয়। মজার বিষয় হল, প্রতিবছর বর্ষাকালে নদীতে জলস্ফীতি দেখা দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং প্রশাসনের মনে পড়ে সেই বাঁধের কথা। ঠিক তখনই দুর্বল বাঁধে বালির বস্তা (জিও ব্যাগ) ফেলে জল আটকানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই এসব চেষ্টা নস্যাৎ করে জল ঢুকে প্লাবনের সৃষ্টি করে। আসলে দুর্বল ইঅ্যান্ডডি বাঁধ, বিভাগীয় চরম গাফিলতি, সীমাহীন দুর্নীতি এবং প্রশাসনের উদাসীনতা- সবগুলি বিষয়ই বন্যার পেছনে কাজ করে।
বাইশের জুনের অবিরাম বৃষ্টিপাত এবং প্লাবন বর্তমান প্রজন্ম চিরদিন মনে রাখবে। সে সময় গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী মাত্রায় বেশ কিছুদিন ধরে বৃষ্টিপাত হয়েছিল। মেঘালয়ের মৌসিনরামে একদিনে ৯০০ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে শিলঙের কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতর রেকর্ড করে। সে বছর শিলচরে একদিনে সর্বোচ্চ ২৮৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং মিজোরামের আইজলে ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এই অতিবৃষ্টির কারণে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। ২০২২-এর ১৬ জুন থেকে অত্যধিক বৃষ্টির ফলে একদিকে জমা জলে মানুষকে নাকাল হতে হয়েছে, তেমনি পার্শ্ববর্তী পাহাড়ি অঞ্চলের জল নামায় দিন কয়েকের মধ্যেই বরাক নদী ফের রুদ্রমূর্তির রূপ নেয়। বিপদসীমা অতিক্রম করে ১৮ জুন থেকেই বরাকের জল তরতরিয়ে শিলচর শহরে ঢুকতে শুরু করে। পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে বৃষ্টিও। বেতুকান্দির কাড়ারপার সহ খন্ডিত ও দুর্বল বাঁধের বিভিন্ন অংশ দিয়ে এবং উপচে পড়ে জল ঢুকতে থাকে জনপদে। কিন্তু সেদিন অর্থাৎ ১৮ জুনও তৎকালীন জেলাশাসক নিশ্চিত ছিলেন, শহরে বন্যা হচ্ছে না। বেতুকান্দির বাঁধ ভেঙে তীব্রবেগে নদীর জল শিলচর শহরকে প্লাবিত করার ঘটনা আসলে ‘গুজব’ বলে উল্লেখ করে সেদিন এতে কান না দিয়ে সবাইকে নিশ্চিন্তে থাকার আহ্বান জানান তিনি। সেই সঙ্গে গ্রাম কাছাড়ের বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে চব্বিশ ঘন্টার জন্য ‘হেল্পলাইন’ চালুর কথাও ঘোষণা করেন। সেদিন জেলাশাসকের অভয়বাণী শোনার পর সবাই নিশ্চিন্তে ছিলেন। কিন্তু সে রাতেই একাংশ শহরবাসী টের পেয়ে যান, বড় বিপর্যয় আসছে। বন্যার জলের প্রবল স্রোত আর সংহারী শব্দ শুনে মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ১৮ জুন রাত থেকে বন্যার জল মহিষাবিল, বেতুকান্দি, বেরেঙ্গা, বড়জুরাই সহ গোটা বরাকপার প্লাবিত করে ক্রমশ শহরের পাব্লিক স্কুল রোড, বিলপার, লিঙ্করোড, মধুরবন্দ, ফাটক বাজারের দখল নিতে থাকে। ১৯ জুন পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে। শহরের রাঙ্গিরখাড়ি, ন্যাশনাল হাইওয়ে, আশ্রম রোড, বৃহত্তর মালুগ্রাম, তারাপুর ইত্যাদি এলাকায় সগর্জনে বন্যার জল ঢুকে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। দেখতে দেখতে ১৯, ২০ ও ২১ জুন শহরের অধিকাংশ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। বিভিন্ন এলাকায় মানুষের ঘরের প্রথম তলা অবধি বন্যার জলে ডুবে যায়। সেই বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রশাসন সহ সাধারণ মানুষকে কতটা বেগ পেতে হয়েছে, তা প্রত্যক্ষদর্শী মাত্রেই জানেন। গ্রাম কাছাড় তথা উপত্যকার বিভিন্ন স্থানের হাজার হাজার মানুষ সেদিন উদ্ধার ও ত্রাণ বন্টনে না নামলে শিলচরে মৃত্যুর মিছিল দেখা যেত। তবু সেই বন্যা বহু মানুষকে কেড়ে নিয়েছে। সীমাহীন সম্পত্তি বিনষ্ট হয়েছে।
বাইশের বন্যায় রাজ্যের ৩৩টি জেলার মধ্যে ৩২ জেলার প্রায় পাঁচ হাজার গ্রামের অন্তত এক কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রায় ২ লক্ষ বিঘা কৃষি ভূমি বিধ্বস্ত হয়েছে। রাজ্য সরকারের হিসেব অনুযায়ী, সেই বন্যায় রাজ্যে মোট ১৮৭টি নদী বাঁধ ভেঙে পড়ে। প্রায় দু’শটি সেতু সম্পূর্ণ বা আংশিক নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ৩৬১১টি সড়ক ধসে যায়। একইভাবে প্রলয়ঙ্করী বন্যা রাজ্যের ২৬৮১টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র সহ সহস্রাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। স্বাস্থ্য বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্যে ৮০টি চিকিৎসালয় বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিস্তর ক্ষতিসাধন হয়েছে। পর পর দু’মাসে দু’টি বন্যায় কয়েকশ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। বাইশের জুনের দ্বিতীয়বারের বন্যা রাজ্যের মোট ৩৩টি জেলার মধ্যে ৩২টিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যদিও বন্যার তাণ্ডবলীলায় প্রথম সারিতে ছিল কাছাড় এবং নগাঁও জেলা। সব মিলিয়ে দু’বারের বন্যায় রাজ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকা হবে বলে সরকারের সর্বশেষ হিসেবে প্রকাশ পায়।
জাতীয় বন্যা কমিশনের সমীক্ষা অনুযায়ী, আসামের বন্যা অধ্যুষিত এলাকার পরিমাণ ৩১,৫০০ বর্গ কিমি বা ৩১.০৫ লক্ষ হেক্টর ভূমি। রাজ্যের সর্বমোট ভূমি সম্পদ হল ৭৮.৫২৩ লক্ষ হেক্টর। অর্থাৎ, ৩৯.৫৮ শতাংশ ভূমি বন্যার দ্বারা প্রভাবিত। দেশের জাতীয় গড় সেখানে মাত্র ১০ শতাংশ। বরাক উপত্যকার ২২,২৪৪ বর্গ কিমির মধ্যে ৯০০০ বর্গ কিমি বন্যাপ্রবণ। পরিসংখ্যা অনুযায়ী, অসমের বার্ষিক বন্যাক্রান্ত গড় এলাকা হল ৯.৩১ লক্ষ হেক্টর ভূমি। প্রতিবছর রাজ্যে তিন-চার বার বন্যার তাণ্ডবলীলা লক্ষ্য করা যায়। বন্যার ফলে প্রতিবছর রাজ্য বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সেটার গড় পরিমাণ ২০০ কোটি। কিন্ত রাজ্যের বন্যাকে আজ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার ‘জাতীয় বিপর্যয়’ বলে ঘোষণা করেনি।
অসমে এই প্লাবনের অন্যতম কারণ হল অত্যধিক বৃষ্টিপাত। সেই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর এবং মিজোরাম থেকে নেমে আসা উপনদীসমূহ এবং পাহাড় থেকে আসা জলস্রোতও অন্যতম প্রধান কারণ। ব্রহ্মপুত্র, বরাক এবং তার উপনদীগুলির সৃষ্টি করা ভাঙন ও ভূমিধসের ফলেও রাজ্যটিকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। একটি তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় দশকে ভূমিধসের ফলে অসমের ৪.২৮ লক্ষ হেক্টর ভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যা ছোট্ট রাজ্য গোয়ার মোট ভূখন্ড (৩৭০২ বর্গ কিলোমিটার) থেকেও বেশি। অসমের মোট ভূখণ্ডের ৭.৪০ শতাংশ ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে নদীগর্ভে। বছরে ৮০০০ হেক্টর ভূমি বন্যা ও ধসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা একটি রাজ্যের কাছে কতটা দুর্ভাগ্যজনক, তা সহজেই অনুমেয়। শুধু কী তাই? ফি বছরের বন্যা ও ভূমিধসে কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, কত রাস্তা, সেতু, স্কুল-কলেজ, সরকারি স্থাপনা, কত ঘর বাড়ি, জমির ফসল, গোবাদি পশু, অন্যান্য সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের উপার্জনের উৎস, জীবন যাপনের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে, তার সঠিক পরিমাপ কখনও হয় না। তা সম্ভবও নয়। এক কথায়, বন্যা অর্থনীতিতে মোক্ষম আঘাত হানে।
বাইশের জুনে প্রলয়ঙ্করী বন্যার কারণ অনুসন্ধান করেছে বিজ্ঞান ভিত্তিক সংগঠন ‘মার্চ ফর সায়েন্স’ শিলচর চাপ্টার। সে বছরের ১০ থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত চারদিন ধরে শিলচরের শহরতলি তোপখানা থেকে সোনাবাড়িঘাট পর্যন্ত বরাক নদীর তীরে তীরে ৩২ কিলোমিটার জায়গা পায়ে হেঁটে সরজমিনে তথ্য অনুসন্ধান করে দশজনের একটি দল। তথ্য অনুসন্ধানের পর শিলচর শহর ও জেলাবাসীকে বন্যার করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে কয়েকটি দাবি অতি দ্রুত পূরণের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়।
তাদের দাবিগুলি ছিল-
১) তোপখানা থেকে সোনাবাড়িঘাট পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণ উচ্চতা বজায় রেখে বাঁধের সংস্কার এবং কিছু স্থানে প্রয়োজনে নতুন করে নির্মাণও করতে হবে। কাশিপুর নাথপাড়া, রায়গড় দাসপাড়া, শিববাড়ি রোড, রেল স্টেশন সংলগ্ন নিউ কলোনি, মধুরবন্দ থেকে কাড়ারপার, ভাগাডহর নয়াগ্রাম থেকে বেরেঙ্গা খাস, ওল্ড লক্ষীপুর রোড সংলগ্ন বেরেঙ্গা পার্ট-১ থেকে সিরাজ মিয়ার কাঠের মিল, গঙ্গাপুর ফেরিঘাট, সোনাবাড়িঘাট সেতু সংলগ্ন এলাকার ভাঙা বাঁধগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
২) তোপখানা থেকে সোনাবাড়িঘাট পর্যন্ত স্লুইস গেটগুলোকে কার্যক্ষম করতে হবে।
৩) বাংলাঘাটের বেড়াখাল ও রাঙ্গিরখালের স্লুইস গেটের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
৪) কাড়ারপারের অসম্পূর্ণ স্লুইস গেটটিকে চওড়া করে দ্রুত নির্মাণ করতে হবে।
৫) মহিষাবিল থেকে ঘাগরা পর্যন্ত রাঙ্গিরখাল এবং এতে সংযুক্ত হওয়া লঙ্গাইখাল ও সিঙ্গিরখালকে জবরদখল মুক্ত করে আদি গভীরতা পর্যন্ত খনন করতে হবে এবং প্রয়োজনে দু’পাশে রাস্তা সহযোগে বাঁধের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬) শহরের প্রতিটি নালা, নর্দমার পূর্ণ সংস্কার করতে হবে।
৭) বরাক ও ঘাগরা নদী খনন করতে হবে এবং লক্ষীপুর–করিমগঞ্জ পর্যন্ত জাতীয় জলপথ চালু করে তাতে নিয়মিত জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮) বরাক ও তার উপনদীসমুহের ভাঙ্গা বাঁধ সংস্কার ও নদী ভাঙ্গনের প্রতিরোধের স্থায়ী সমাধান করতে হবে। বন্যায় বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত গঙ্গাপুর ও মানিকপুরের ভাঙ্গন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মেরামত করতে হবে।
৯) বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতিতে রোগ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে প্রতিটি পুরসভা এবং পঞ্চায়েত ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত বিজাণুনাশক সামগ্রী ছড়ানোর ব্যবস্থা এবং বিশুদ্ধ পানীয়জলের ব্যবস্থা করতে হবে।
১০) শহরের পাশাপাশি প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও ওয়ার্ডে স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন করতে হবে।
সংস্থার দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর বন্যার কারণ এবং বন্যা মোকাবিলায় যে সব পদক্ষেপ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, রাজ্য সরকার বা জেলা প্রশাসন সেসব নিয়ে কতটুকু যত্নশীল তার কোনও আভাস এযাবৎ মেলেনি। ‘মার্চ ফর সায়েন্স’ ছাড়াও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকেও বন্যার কারণ উদ্ভাবন এবং বন্যা মোকাবিলায় বিভিন্ন পরামর্শ সরকারের কাছে জমা পড়ে। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্যার ওপর একটি সেমিনারেরও আয়োজন করা হয়। সেখানেও বিভিন্ন গবেষণাপত্র জমা পড়ে। কিন্তু সেই সব রিপোর্ট-পরামর্শ বা দাবি বাস্তবায়িত হয়েছে কি না, হলে কতটা হয়েছে, কিছুই জানা যায়নি।
বিপর্যয় যখন বিপদসীমা অতিক্রম করে তখন পুরু চামড়াওয়ালাদেরও সম্বিৎ ফেরে। সাধারণ মানুষের আতঙ্ক থেকেই সেই বিপদের মোকাবিলা করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে তখন। তাই বাইশের মহাপ্লাবনের পর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চেতনা ফিরবে, এমনটাই আশা করেছিলেন মানুষ। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল অন্য ছবি। সেই প্লাবনের পর এক বছর কেটে গিয়েছে। এই সময়ে বন্যা মোকাবিলায় কী কী পদক্ষেপ করা হয়েছে, তা শহরবাসীর অজানা নয়। বেতুকান্দির অর্ধসমাপ্ত স্লুইস গেট নির্মাণ এবং কাড়ারপার সহ বিভিন্ন স্থানের বাঁধের সংস্কার সাধন করা হয়েছে অবশ্যই। ২০২২ সালের এপ্রিলের পর আজ অবধি শহরের নালা নর্দমার সাফাই, খালগুলির সংস্কার কিছুই হয়নি। বরং পানীয়জল প্রকল্পের নামে রাস্তা-নালা কেটে এবং অপরিকল্পিতভাবে পাকা নালা নির্মাণের নামে গোটা শহরকে বর্ষার আগে যুদ্ধবিধ্বস্ত রূপ দেওয়া হয়েছে। তবে অবশ্য ঢাক ঢোল পিটিয়ে রাঙ্গিরখাল সহ বিভিন্ন এলাকায় কিছুদিন অবৈধ দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদের কাজ হয়েছে। অবশ্যই জমা জল নিষ্কাশনের জন্য শিলচরে বহু টাকা খরচ করে সাকার মেশিন আনা হয়েছে। যা ব্যবহারের চেয়ে বেশিরভাগ সময় পুরসভার ঘরে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। এর বাইরে শহরকে জমা জলের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে এবং বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলায় সরকার যদি আরও কোনও পদক্ষেপ করে থাকে সেটা লোকচক্ষুর অন্তরালে হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে পর্যন্ত সে সবের খবরটুকু আসেনি। বর্ষা বা মৌসুমি বায়ুর প্রকোপ এখনও এ অঞ্চলে না এলেও বৃষ্টি নেমেছে। এবার তাও অনেকটাই দেরীতে। কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টিতে বর্তমানে গোটা শহর জমা জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। এই জমা জলে নেতা-মন্ত্রীদের উন্নয়নের ফিরিস্তি ভেসে বেড়াচ্ছে বলে প্রতিদিনই সামাজিক মাধ্যমে মিম দেখা যাচ্ছে। এখন প্রতিটি নদীর জলস্তর বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতিতে এবার ঘরপোড়া গরুর মতো শহরবাসীও সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। এবারও জুন মাসটা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে কি না, সেই দুশ্চিন্তায় শহরবাসীর কাটছে প্রতিটা মুহূর্ত। ###