উত্তমকুমার সী
‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ বলে একটা কথা বর্তমান পরিবর্তনের দেশে বেশ প্রচলিত। সরকার বা শাসক দলের বিরুদ্ধে কেউ কোনও কথা বললেই তাঁকে ওই অদৃশ্য গ্যাঙের সদস্য বলে প্রচার করা হয়। দেশের একটা বড় অংশের মানুষকে চিরকাল অন্ধভক্ত করে রাখার উদ্দেশ্যে এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে এই প্রচারের ঢেউ চলছে। আর সেই ভক্তরাও সামান্য মতের অমিল হলেই কাউকে ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ উপাধি দিয়ে আত্মতুষ্টি লাভ করেন। আসলে বর্তমানে দেশজুড়ে এই ‘টুকরে টুকরে’-র রাজনীতি চলছে। ‘কল্যাণকামী’ রাষ্ট্র ব্যবস্থাই প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষকে ভাগ করে শাসন ব্যবস্থা কায়েম রাখার কাজ করে চলেছে। যার সর্বশেষ এবং আমাদের কাছের উদাহরণ সাম্প্রতিক অসমের বিধানসভা ও লোকসভা কেন্দ্র পুনর্গঠন বা ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া।
নির্বাচন কমিশনের বিশেষ কমিটি দীর্ঘদিনের বিচার-বিশ্লেষণের পর নাকি ডিলিমিটেশনের এই খসড়া প্রকাশ করেছে। কিন্তু দেখা গেছে, রাজ্যের মোট আসন সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখলেও বরাক উপত্যকা থেকে দু’টি আসন বিলুপ্ত করা হয়েছে। তফসিলি সংরক্ষিত করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী শিলচর লোকসভা কেন্দ্র। ২০০৭ সালে সারা ভারতের ডিলিমিটেশনের সঙ্গে অসমেরও খসড়া রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু তখন নাগরিকত্ব নির্ধারণ প্রক্রিয়া বা এনআরসি সম্পন্ন হয়নি বলে অসমে তা প্রযোজ্য হয়নি। সেই রিপোর্টেও বরাকের বিধানসভার সংখ্যা ১৫টি ছিল। শিলচর কেন্দ্র ছিল বরাবরের মতো সাধারণ। এনআরসি আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ না হলেও এবারের ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে বরাকের দু’টি বিধানসভা আসন কেটে ফেলা হয়েছে। পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে বড়োল্যান্ডে। ২০০১ সালের সালের জনগণনার ভিত্তিতে নির্বাচন কেন্দ্র পুনর্গঠনের জন্য গঠিত ডিলিমিটেশন কমিশন যে সাংবিধানিক ও আইনি বিধির ভিত্তিতে গাইডলাইন তৈরি করে তাতে উল্লেখ রয়েছে, ৪-০২-২০০৪ এবং ০১-০৮-২০০২ তারিখের পর আর জেলার সীমা পরিবর্তন করা যাবে না। তবে কোনও নির্দিষ্ট প্রশাসনিক ও অন্যান্য যুক্তিসম্পন্ন কারণ দেখানো হলে সেটা সম্ভব হবে। কিন্তু অসম সরকার ৩১-১২-২০২২ তারিখে এক আদেশে বরাকের তিন জেলার প্রশাসনিক সীমা বদলে দেয়। আর ০১-০১-২০২৩ তারিখ থেকে প্রশাসনিক সীমা আর বদলানো যাবে না বলে নির্বাচন কমিশন নতুন আদেশ জারি করে। এতে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক, ডিলিমিটেশনের উদ্দেশ্যেই সেদিন প্রশাসনিক সীমা বদল করা হয়েছিল। এতে কমিশনের মূল গাইডলাইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অবৈধ বলে দাবি করে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে তা বাতিলের আওয়াজ উঠেছে।
মূল গাইডলাইনে জনসংখ্যার ঘনত্বের ওপর ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া চালানোর কোনও উল্লেখ নেই। নির্বাচন কমিশন সেই নতুন প্রক্রিয়া সংযোজন করে এবং তাতে কোনও সাংবিধানিক বা আইনি কারণ দেখানো হয়নি। সাধারণত জনসংখ্যা বাড়লে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বাড়ার কথা। বরাক উপত্যকার মত প্রান্তিক অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব যেহেতু বেশি, তাই জনসংখ্যা বেশি হওয়ার কথা। ফলে জনগণের কথা বিধানসভায় তোলে ধরার জন্য প্রতিনিধিও বাড়ার কথা। তবু বাঙালি অধ্যুষিত বরাকে সেই সংখ্যা দু’টি কমানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন কিছু দাবির ভিত্তিতে জনসংখ্যার ঘনত্বকে মেনে নিয়ে এক অদ্ভূত ফর্মুলা আবিষ্কার করেছে, যাতে বরাক উপত্যকা ও নিম্ন অসমের কয়েকটি জেলার বিধায়ক সংখ্যা কমে যায়। গাইডলাইনে নির্বাচন কমিশনের এই সংযোজন যেহেতু অসাংবিধানিক ও অযৌক্তিক, তাই সেই ধারাও বাতিলের দাবি উঠেছে।
এই খসড়ার সঙ্গে সরকার বা শাসক দলের কোনও সম্পর্ক নেই বলে বারবার ঘোষণা করছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কমিটি পুরো প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। খসড়ার সমর্থন জানিয়ে ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, এই ডিলিমিটেশনের ফলে রাজ্যের ‘খিলঞ্জিয়া’র অধিকার সুরক্ষিত হবে, ‘প্রকৃত ভারতীয়’রা এর আপত্তি জানাতে পারেন না, এর ফলে আগামী ২৫ বছর অসম সুরক্ষিত থাকবে ইত্যাদি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি বরাকের ক্ষেত্রে কীভাবে প্রযোজ্য হবে? বরাকের তিন জেলা থেকে যে দু’টি আসন কেটে ফেলা হয়েছে, সেখানকার বাসিন্দারাও তো ‘খিলঞ্জিয়া’ বা ভূমিপুত্র। এই দুটি কেন্দ্রকে অন্যান্য কেন্দ্রের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ফলে জনসংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। এতে স্বাভাবিক উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হবে। ফলে এই খসড়া বরাকের ভূমিপুত্রদের অধিকার আসলেই সুরক্ষিত করছে না। অন্যদিকে, ডিলিমিটেশনের খসড়া প্রকাশের পর যখন গোটা রাজ্যের সঙ্গে বরাক উপত্যকাতেও প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে, তখন মুখ্যমন্ত্রী প্রতিবাদকারীদের দমাতে ‘প্রকৃত ভারতীয়রা এই খসড়ায় খুশি’ বলে দাবি করেছেন। এক্ষেত্রেও বিভাজনের একটা ছাপ লক্ষ করা যাচ্ছে।
বিজেপি নেতারাও সরকারের সুরে সুর মিলিয়ে ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়ার সমর্থন করে যাচ্ছেন। গুয়াহাটিতে কোনও কোনও নেতা প্রকাশ্যে বলছেন, বরাকের দু’টি সংখ্যালঘু কেন্দ্র বিলুপ্ত করা হয়েছে। এতে নাকি হিন্দুদের অধিকার সুরক্ষিত হবে। এসব কথায় বরাকের নেতারাও নতুন করে রাজনীতির ছক কষতে শুরু করেছেন। আসলেই কী কাটলিছড়া ও পাথারকান্দি কেন্দ্র এতদিন সংখ্যালঘুদের দখলে ছিল? ইতিহাস বলছে অন্য কথা। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৫ বার বিধানসভা নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। পাথারকান্দি আসনে ১৩ বারই হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। আর কাটলিছড়া কেন্দ্র থেকে গৌতম রায় ছয়বার, সন্তোষ রায় একবার, গৌরিশঙ্কর রায় চারবার, তজমুল আলি লস্কর দু’বার এবং সুজাম উদ্দিন লস্কর দু’বার নির্বাচিত হয়েছেন। ১৫টি বিধানসভা নির্বাচনে কাটলিছড়ায় ১১ বারই জয়ী হয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রার্থী। তাই বিজেপি নেতাদের এই ‘হিন্দুদের মেরে হিন্দু প্রেম’-এর রাজনীতির বেলুন ইতিমধ্যে চুপসে গেছে। সাধারণ মানুষ তাদের উদ্দেশ্য বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন। এই ডিলিমিটেশনে দু’টি আসন বিলুপ্তি এবং বাকি ১৩টি আসনকে যথেচ্ছভাবে কাঁটাছেঁড়া করে বরাকের বাঙালির রাজনৈতিক ভিত্তি নষ্ট করার পাশাপাশি স্বাভাবিক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত রাখার বন্দোবস্ত পাকা করে ফেলা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী শিলচর লোকসভা আসনকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত করে এখানকার সুশীল সমাজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়েছে। আর এ সবকিছুই হয়েছে বর্তমান শাসক দলের নেতাদের অঙ্গুলিসংকেতে। এখন সাধারণ মানুষের ঘুম ভাঙলে এই খসড়ার বিরুদ্ধে আপত্তি ও প্রতিবাদ জোরালো হবে। আর দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে ওঠে বরাকের সবাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সামিল হলে হয়তো সরকারের ‘টুকরে টুকরে’-র রাজনীতি আপাতত পন্ড হবে। বরাক ফিরে পাবে তার ন্যায্য ১৫টি আসন। শিলচর পাবে তার প্রাপ্য মর্যাদা। এখন রাজনীতির নোংরা জল কোন দিকে গড়ায়, সেটাই দেখার।। ###