সম্পাদকীয়
ওডিশার বালাসোরের রেল দুর্ঘটনা ভারতের কয়েক বছরের মধ্যে সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ঘটনার অন্যতম। শুক্রবারের এ দুর্ঘটনায় দুটি যাত্রীবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে কমপক্ষে ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৯০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। এমন রেল দুর্ঘটনা ভারতে অস্বাভাবিক নয়। গত বছর প্রকাশিত কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেলের প্রতিবেদন মতে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত দশটি বড় দুর্ঘটনার সাতটিই ঘটেছে লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে। ২০২২ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় রেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৩৮.২ শতাংশ। এ সময়ে হয় রেল থেকে পড়ে, না হয় লাইনচ্যুত হয়ে ১১ হাজার ৩৬ জন যাত্রী নিহত হন। ভারতীয় রেলওয়ের মতে, ২০২১-২২ সালের মধ্যে ৩৪টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে রয়েছে সংঘর্ষ, লাইনচ্যুত, ট্রেনে আগুন বা বিস্ফোরণ, লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে রাস্তার যানবাহন সংঘর্ষ ইত্যাদি। সংখ্যার হিসেবে আগের বছরের তুলনায় ২৭টি বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০২২-২৩ সালে এই ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে ৪৮টি হয়েছে।
২০১৯ সালে রেল সংক্রান্ত সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি জানিয়েছিল, দক্ষিণ-পূর্ব রেলের বিভিন্ন রুটে কর্মীর অভাবে সঠিকভাবে ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হচ্ছে না। ৩ বছর আগেই সতর্ক করা হয়েছিল, দক্ষিণপূর্ব রেলে বিপুল শূন্যপদের জন্য দুর্ঘটনার সম্ভাবনা ক্রমশ বাড়ছে। এই কমিটির অনুসন্ধান অনুযায়ী প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মীর পদ এখনও শূন্য। এই কর্মীর অভাবে রেলে যাত্রী নিরাপত্তায় বড়সড় গলদ থেকে যাচ্ছে। রেল মন্ত্রকের এই উদাসীনতা বিপদ ডেকে আনতে পারে। ২০১৯ সালে রেল সংক্রান্ত সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি এই রিপোর্ট দিলেও কেন্দ্র সেটাকে পাত্তা দেয়নি। দক্ষিণ পূর্ব রেলে নতুন করে কর্মী নিয়োগ হয়নি। উলটে শূন্যপদ আরও বেড়ে গিয়েছে। গুরুত্ব পাচ্ছে না কবচও। প্রায় ৬ মাস আগে এই প্রযুক্তি ছাড়পত্র পাওয়া সত্ত্বেও দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ রুটে এখনও কবচ নেই। ২০১৯ সালে সংসদীয় কমিটির সেই সতর্কবার্তা কেন্দ্র মেনে নিলে আদৌ বালাসোরের দুর্ঘটনা এড়ানো যেত কিনা, সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু তাতে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা যে অনেকটা কমে যেত, তাতে সংশয় নেই। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪-১৫ সাল থেকে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষ পর্যন্ত ছোটবড় মোট ৬৩৮টি রেল দুর্ঘটনা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে পাটনায় রেল দুর্ঘটনায় দেড়শোর বেশি মানুষ মারা যান। ২০১৪ সালে উত্তরপ্রদেশে গোরক্ষধামে দুর্ঘটনা, ২০১৭ সালে পুরী-হরিদ্বার উৎকল এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনার ক্ষত এখনও টাটকা আমনাগরিকের মনে। আসলে চালকের ত্রুটি, নাশকতা, সিগন্যাল গার্ডের দায়িত্বহীনতা ও কারিগরি ত্রুটিও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
ভারতের রেল বিশ্বের প্রাচীনতম ট্রেন নেটওয়ার্কগুলোর অন্যতম। রেল নেটওয়ার্ক অনেক বেশি প্রসারিত হলেও এর ওপর চাপ অত্যধিক। যে কারণে চলমান ট্রেনগুলোতে সুরক্ষার কাজ চালানোর ফুরসত কম। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে যত লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ২৬ শতাংশের কারণ ছিল রেললাইন সংস্কারের জন্য তহবিলের ঘাটতি এবং বরাদ্দ থাকা তহবিলের যথাযথ ব্যবহার না করা। সেখানে নতুন রেল উদ্বোধনে ব্যয় হলেও সুরক্ষা ব্যবস্থা ও পরিকাঠামো সংস্কারে যথাযথ ব্যয় হচ্ছে না। এর ফলে লাইনচ্যুতি ঠেকাতে রেললাইনের ব্যবস্থাপনা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টিতে কম নজর পড়ছে।
রেললাইনের অত্যধিক ব্যবহারের পাশাপাশি কোচে ওভারলোডিংকেও উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতের চারটি প্রধান স্টেশন–দিল্লি, হাওড়া, মুম্বাই এবং চেন্নাইয়ের মধ্যে ট্রাঙ্ক লাইনগুলোতে বছরের পর বছর ধরে নতুন কোনও লাইন সংযোজন হয়নি বা লাইন দ্বিগুণ করতে দেখা যায়নি। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী ২০১৬ সালে পরামর্শ দিয়েছিলেন, রেলওয়ের অভ্যন্তরীণ আয়ের ওপর নির্ভর করার পরিবর্তে সরকারকে এই খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বস্তুত রেললাইন উন্নততর করা এবং আরও লাইন নির্মাণসহ পরিকাঠামোগত সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অতিরিক্ত চাপ সহ্য করার জন্য অবকাঠামোর সক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য সমীক্ষা চালানো উচিত। ফেব্রুয়ারির শুরুতে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ভারতীয় রেলওয়ের জন্য ২ দশমিক ৪০ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের ঘোষণা করেছিলেন, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। কেন্দ্র সরকারকে রেলখাতে আরও অধিক ব্যয়ের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, রেলওয়ের পরিকাঠামোগত খরচ অনেক বেশি, সেজন্য কেবল রেলের পক্ষে তা বহন করা কঠিন। সেইসঙ্গে ভারতীয় রেলের আয় এবং ব্যয় সমান হওয়ার প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে এবং এর সক্ষমতার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ব্যবহার করা উচিত, তবেই রেল লাইনচ্যুতি নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং রেল নেটওয়ার্কের আরও কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত হবে।