অনলাইন ডেস্ক : ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি -সহ নারী নির্যাতনের মামলায় দ্রুত বিচার চাইছেন সাধারণ মানুষ। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন। বিচার প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণে অনেক সময় ‘মব-লিঞ্চিং’ এর মতো ঘটনাও ঘটছে। এতে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে সরকারের ওপর। এমন প্রেক্ষাপটে ধর্ষণ মামলায় আইনজীবীরা যাতে বিচারপ্রক্রিয়ায় বিলম্ব না ঘটান, এই আবেদন জানালেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা।
শিলচরে জেলা বার সংস্থার সার্ধশতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে শনিবার তিনি কলকাতা আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ কাণ্ড এবং সম্প্রতি অসমের নগাঁও জেলার ধিং-এ সংঘটিত নাবালিকা গণধর্ষণের ঘটনাকে সামনে রেখে অত্যন্ত খোলামেলা ভাষায় জানিয়ে দেন, এধরণের বর্বরোচিত ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে আদালতে বারবার সময় চেয়ে যেন অযথা বিলম্ব না ঘটানো হয়। আইনজীবীরা যেন বিচারবিভাগীয় আধিকারিকদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। যাতে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হয় এবং সুবিচার পায় পীড়িত পরিবার। তিনি বলেন, ধর্ষণ বা অন্যান্য নারী নির্যাতনের মামলায় যত দ্রুত রায় ঘোষণা হবে ততই বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা বাড়বে সাধারণ মানুষের। এদিন বক্তব্য রাখতে গিয়ে ধর্ষণ মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার জন্য অত্যন্ত কৌশলে একাংশ আইনজীবীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান মুখ্যমন্ত্রী। শুধু এ-ই নয়, ওইসব আইনজীবীদের আত্মমন্থনের আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ধর্ষণের মতো অমানবিক ঘটনার তাৎক্ষণিক বিচার এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার দাবিতে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এতে জলের মতো পরিষ্কার, দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বিচার ব্যবস্থার ওপর সেভাবে ভরসা রাখতে পারছেন না মানুষ। তাই এ ধরনের ঘটনায় দ্রুত পদক্ষেপ করার জন্য তাঁরা চাপ সৃষ্টি করছেন রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীর ওপর। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক নেতা চাইলেও এমনটা করতে পারেন না। কারণ, একমাত্র বিচারব্যবস্থা -ই পারে অপরাধের সাজা সাব্যস্ত করতে। এবং ধর্ষণ জাতীয় মামলা যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, এই ক্ষেত্রে আইনজীবীদের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা আদালতে অপ্রয়োজনে সময় প্রার্থনা না করলে বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়বে বিচার ব্যবস্থার ওপর।
জেলা বার সংস্থার সার্ধশতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রায় ৩৭ মিনিট বক্তব্যে নানা প্রসঙ্গ ছুঁয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। ১৮৭৪ সালে মাত্র তিন ব্যবহারজীবীকে নিয়ে শুরু হওয়া জেলা বার সংস্থার নানা ঘটনাবলীর ওপর আলোকপাত করে তিনি বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্যবহারজীবীরা এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের গণতান্ত্রিক ভিত মজবুত করতেও পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধী সরদার বল্লবভাই প্যাটেল, ড° বিআর আম্বেদকর, রাজেন্দ্র প্রসাদদের মতো মনীষীদের নামোল্লেখ করেন তিনি। বলেন, ইন্দিরা গান্ধীর জমানায় জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল দেশে। সেসময়ও এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন ননি পালকিওয়ালা, ফালি এস নরিম্যান, রাম জেঠমালানির মতো আইনজীবীরা। রাজনৈতিক বন্দীদের সুরক্ষা প্রদান এবং সংবিধান রক্ষার জন্য অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন নরিম্যান। মোট কথা, মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সর্বশক্তি দিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন আইনজীবীরা।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ম এবং আইনের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়কালে আইন ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য বিবর্তন ঘটেছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আইন মেনে চলাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বৃটিশ প্রবর্তিত ঔপনিবেশিক আমলের আইপিসি, সিআরপিসিসি ও ইন্ডিয়ান এভিডেন্স আইন কখনও দেশবাসীকে সুবিচার দিতে পারে না। কেননা, এগুলো তৈরিই হয়েছিল বৃটিশদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য। কিন্তু আক্ষেপের কথা, স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরও এগুলো বহাল রয়েছে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি প্রবর্তিত ভারতীয় ন্যায় সংহিতার কথা উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা এবং সাক্ষ্য অধিনিয়ম শীর্ষক ওই তিনটি আইন ‘ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ জমানার প্রভাব এবং দাসত্বের মানসিকতা দূর করবে। সম্পূর্ণ ভারতীয়ত্বে মোড়া বিজ্ঞানসম্মত এই ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে একগুচ্ছ কড়া পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।প্রসঙ্গক্রমে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, সে স্থাপত্য হোক বা অন্য কিছু, ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদের সঙ্গে জড়িত যা যা নিদর্শন রয়েছে দেশে, তা নতুন করে বিনির্মাণ, প্রয়োজনে সরিয়ে দেওয়া উচিত। কেননা, একদিন ওইসব ভবনে বসেই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের ব্লু প্রিন্ট রচনা করেছিল ব্রিটিশরা। তাই এগুলো কোনও অর্থেই দেশের ঐতিহ্য নয়, বরং অত্যাচার এবং অবিচারের প্রতীক। এদিন অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন গৌহাটি হাইকোর্টের বিচারপতি কল্যাণ রায় সুরানা, জেলা বার সংস্থার সভাপতি দুলাল মিত্র, সম্পাদক নীলাদ্রি রায় প্রমুখ। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কাছাড়ের অভিভাবক মন্ত্রী জয়ন্ত মল্ল বরুয়া, বিধায়ক কৌশিক রায়, দীপায়ন চক্রবর্তী, মিহির কান্তি সোম, গৌহাটি হাইকোর্টের বরিষ্ট আইনজীবী হাফিজ রশিদ আহমদ চৌধুরী, জেলাশাসক রোহন কুমার ঝা, বর্ষীয়ান আইনজীবী বিমানকুমার আচার্য, বিথীকা আচার্য প্রমুখ। সঞ্চালনায় ছিলেন আইনজীবী দেবমিতা চক্রবর্তী।