অনলাইন ডেস্ক : উন্নত চিকিৎসার আশায় খরচ কবুল করেও রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান পরিজনেরা। কিন্তু সেখানেই যদি চিকিৎসার গাফিলতিতে মৃত্যু ঘটে রোগীর, সাধারণ মানুষ ভরসা করবেন কার ওপর ! শিলচর রাঙ্গিরখাড়ি এলাকার সিটি মেটারনিটি নার্সিং হোমে অস্ত্রোপচারের পর এক প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনাকে ঘিরে এই প্রশ্ন-ই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে শহরে। গুরুতর অভিযোগ উঠেছে চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ অরুণ দেবনাথের বিরুদ্ধে। অভিযোগ এনেছেন প্রয়াত সুস্মিতা রায়ের বাবা গুয়াহাটি এজি অফিসের কর্মী বাবলা রঞ্জন রায়, মা শঙ্করী রায়, স্বামী অ্যাক্সিস ব্যাংকের ক্লাস্টার ম্যানেজার কুমারজিৎ দেব, ভাসুর কিশলয় দেব-সহ অন্যান্যরা। তাঁরা বলেছেন, অস্ত্রোপচারের মাত্র ১২ ঘণ্টা আগেও যে প্রসূতি ছিল পুরোপুরি সুস্থ, অস্ত্রোপচারের পর এমন কী ঘটল যে, সেই তিনিই আক্রান্ত হয়ে পড়লেন সেপ্টিসেমিয়ায়। তাঁকে স্থানান্তর করতে হল অন্য এক বেসরকারি নার্সিংহোমের আইসিইউতে ! সেখানে প্রায় ২২দিন যমে মানুষে টানাটানির পর রোগীর মৃত্যু হল একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে ! তাও মাত্র ২৮ বছর বয়সে ! এর একটা বিহিত তদন্ত জরুরি। এজন্য মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সহ তাঁরা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী কেশব মহন্তেরও। দাবি জানিয়েছেন, উপযুক্ত তদন্ত করে সিটি মেটারনিটি নার্সিং হোমের লাইসেন্স বাতিল করা হোক। বিহিত ব্যবস্থা নেওয়া হোক ডাঃ অরুণ দেবনাথের বিরুদ্ধেও।
উল্লেখ্য, প্রয়াত সুস্মিতার বাবার বাড়ি কালাইনে। শ্বশুরবাড়ি লক্ষীপুরে। বিয়ের পর স্বামী কুমারজিতের সঙ্গে থাকতেন শিলচর অম্বিকাপট্টি চৌরঙ্গীর পাশে এক ভাড়াবাড়িতে। তিনি নিজেও চাকরি করতেন শিলচর কৃষি বিভাগে বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রকল্পের অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার পদে। বুধবার শিলচরে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বাবলা রঞ্জন রায়, কুমারজিৎ দেবরা বলেন, গর্ভধারণের শুরু থেকেই ডাঃ অরুণ দেবনাথের তত্বাবধানে চিকিৎসা চলছিল সুস্মিতার। গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত কার্যালয়ে স্বাভাবিকভাবে কর্তব্য সম্পাদন করেন তিনি। বাড়ি ফেরার পর এদিন রাতে পেটে ব্যথা অনুভব করেন। পরদিন ১ এপ্রিল সকালে ডাঃ অরুণ দেবনাথের যোগাযোগ করলে তাঁর পরামর্শে সুস্মিতাকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় সিটি মেটারনিটি নার্সিং হোমে। রোগীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তাঁকে ওই নার্সিং হোমে-ই ভর্তির শলা দেন ডাঃ দেবনাথ। বলেন অস্ত্রোপচারের কথাও। কয়েকঘণ্টা পর এদিন সন্ধ্যারাতে সুস্মিতার অস্ত্রোপচার করেন ডাঃ অরুণ দেবনাথ। রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ জন্ম হয় এক ফুটফুটে পুত্রসন্তানের।
তখন থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত সুস্থ-ই ছিলেন সুস্মিতা, সুস্থ ছিল নবজাতকটিও— বলেন কুমারজিৎ। তাঁর কথা অনুযায়ী অস্ত্রোপচারের পর রাতে নাকি নিজের ফেসবুক দেওয়ালে স্ট্যাটাস আপলোড করা -সহ বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথাবার্তা বলেছেন সুস্মিতা। পরদিন ২ মে সকাল পর্যন্ত কোনও অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েনি। কিন্তু বেলা গড়াতেই বিগড়তে থাকে পরিস্থিতি। কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েন সুস্মিতা। শারীরিক অস্বস্তির কথাও বলেন। বিষয়টি নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হলে শুরুতে তারা এই উপসর্গকে অ্যানেস্থেশিয়ার প্রভাব বলে তেমন গা করেননি। দুপুর ১২টা নাগাদ যখন পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যায়, ময়দানে নামেন ডাঃ অরুণ দেবনাথ। পরীক্ষা করে দেখা যায়, রোগীর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ও রক্তচাপ বারবার ওঠানামা করছে। পেট ফুলে বেঢপ আকৃতি ধারণ করেছে।কুমারজিতের প্রশ্নে চিকিৎসক দেবনাথ জানান, কোনও কারণে সুস্মিতার পাকস্থলীতে প্রচণ্ড পরিমাণে অ্যাসিড জমা হয়ে আছে। সেটা বের করতে হবে। সে অনুযায়ী রোগীর নাকে পাইপ ঢুকিয়ে শুরু হয় অ্যাসিড বের করার প্রক্রিয়া। কুমারজিৎ বলেন, পাকস্থলী থেকে অ্যাসিড বের করা হলে তার রং সাধারণত হালকা সবুজ বা নীলচে হয়। কিন্তু সুস্মিতার পাকস্থলী থেকে বের হওয়া তরলের রং ছিল লালচে। তাঁর সন্দেহ, সেই তরল ছিল রক্তমিশ্রিত। কুমারজিৎ বলেন, এটা দেখার পর ডাঃ পিকে চক্রবর্তী সহ আরও একজন চিকিসককে ডেকে আনেন ডাঃ অরুণ দেবনাথ। এরপর তিনি রোগীর পরিজনদের জানান, সুস্মিতাকে গ্রিনহিলস নার্সিং হোমে আইসিইউতে ভর্তি করাতে হবে। এজন্য ডাঃ দেবনাথ নিজেই একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দেন। চিকিৎসকের পরামর্শে রাত ১০টা নাগাদ প্রসূতি সুস্মিতাকে নিয়ে যাওয়া গ্রিনহিলস নার্সিং হোমে। সেখানে প্রায় ২২ দিন তাঁর চিকিৎসা চলে আইসিইউতে। অবশেষে সব লড়াই থেমে যায় ২৪ মে রাত ১টা নাগাদ। নবজাতককে রেখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মা-বাবার একমাত্র কন্যা সুস্মিতা। স্বজন হারানোর শোকে পাথর হয়ে যায় দু-দুটি পরিবার। জন্মলগ্নে-ই মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় নবজাতকটিও।এই ঘটনায় কুমারজিতের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সন্তানহারা বাবলা রঞ্জন রায়ের পরিবারের সব সমীকরণ গিয়েছে পাল্টে। আর্তনাদের সুরে তিনি বলেছেন, অস্ত্রোপচারের আগে পরীক্ষানিরীক্ষায় ( ১ এপ্রিল রাতে রক্তের নমুনা পরীক্ষা হয়েছে সিটি মেটারনিটি নার্সিং হোমের সিটি ল্যাব-এ) সুস্মিতার যকৃৎ, বৃক্ক থেকে শুরু করে সবকিছু ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু অস্ত্রোপচারের চব্বিশ ঘণ্টা পেরনোর আগেই তিনি আক্রান্ত হয়ে পড়লেন সেপ্টিসেমিয়ায়। সিটি ল্যাব-এর পরীক্ষায় রক্তে যে ক্রিটিনিন ছিল দশমিক ছয় এমজি/ডিএল, পরদিন রাতে সেটাই কিনা ধরা পড়ল ৩৩এমজি/ডিএল-এ। এসজিপিটির বেলায়ও একই ঘটনা। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে যা ছিল ১৬ইউ/এল, অস্ত্রোপচারের পর সেটা ধরা পড়ল ৪হাজার।
চিকিৎসায় বড় ধরনের গাফিলতি না ঘটলে এত অল্প সময়ের মধ্যে কোনও সুস্থ মানুষের এতটা শারিরীক অবনতি ঘটতে পারে না, বলেন কুমারজিৎ। তিনি বলেন, সকালে অস্বস্তি শুরু হলে সঙ্গে সঙ্গে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ! সময়ে অ্যান্টিবায়োটিক পর্যন্ত দেওয়া হয়নি রোগীকে ! এসব কেন ঘটল, কার ভুলে ঘটল, তদন্ত জরুরি। আর সেটাই দাবি করছেন তাঁরা।
তিনি আরও বলেন, শহরের বুকে একটা নার্সিং হোমে মেডিসিনের ডাক্তার নেই, ন্যুনতম সুযোগ সুবিধা নেই, আইসিইউ নেই, এমনকি লিফটটা পর্যন্ত নেই ! এটা ভাবা যায় না। তাঁর আশঙ্কা, সিটি মেটারনিটি নার্সিং হোমের অপারেশন থিয়েটার এবং অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি সময়মতো স্টিরিলাইজ করা হয় কি-না এনিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তা না হলে সুস্থসবল একটা মানুষ অস্ত্রোপচারের পর সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত হয় কী করে।