অনলাইন ডেস্ক : সোমবার আলোড়ন সৃষ্টিকারী সিকরুম নকলকাণ্ডের পর বুধবার কাছাড় কলেজে কোনওধরনের ঝঞ্ঝাট বিনেই গ্রহণ করা হলো উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। এদিন ছিল “এম আই এল”পরীক্ষা। এদিন অবশ্য সোমবারের ঘটনার মূল দুই চরিত্র অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ শঙ্কর নাথের ভাইপো এবং আত্মীয়া (ভাইপোর মামাতো বোন) পরীক্ষা দিয়েছে “সিকরুম”- এর বদলে সাধারন পরীক্ষা কক্ষে। তবে এদিন এদের পরীক্ষা গ্রহণকে ঘিরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন মহল থেকে। নকলে ধরা পড়ার পরও এই দুজনকে ছাড় দেওয়া এবং আনুষাঙ্গিক অন্যান্য তথ্য থেকে চর্চা শুরু হয়েছে, তবে কি গোটা ঘটনার ঝড় নিহিত রয়েছে অসম উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের অভ্যন্তরেই। এসব চর্চার মাঝে এদিন সাসপেন্ড করা হয়েছে অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থবাবুকে।
জানা গেছে সিদ্ধার্থ বাবুর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠার পর, রাজ্যের উচ্চশিক্ষা বিভাগের সঞ্চালক পমি বরুয়া বুধবার এক নির্দেশে তাকে সাসপেন্ড করেন। সিদ্ধার্থ বাবুর সাসপেনশন অবশ্যই এবারই প্রথম নয়। এর আগে তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীর নিযুক্তি পরীক্ষাকে ঘিরে অনিয়মের দরুন প্রায় ৯ মাস সাসপেন্ড থাকার পর ২০২৩ এর আগস্ট মাসে তিনি চাকরিতে পুনর্বহাল হন। এরপর ছয় মাস যেতে না যেতেই এবার ফের নকল কাণ্ডে জড়িয়ে সাসপেন্ড হলেন তিনি।
এদিকে সোমবারের নকল কান্ডকে ঘিরে বর্তমানে চর্চা হচ্ছে কাছাড় কলেজে বাইরে থেকে পরীক্ষা তদারকীর জন্য নিযুক্ত সুপারভাইজিং অফিসার (এস ও)দের ঘিরেও। তাদের নজরদারির মাঝেও কিভাবে “সিকরুম”-এর দরজায় মোটা পর্দা লাগিয়ে অধ্যক্ষের ভাইপো এবং আত্মীয়াকে নকলের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল এই প্রশ্ন উঠছে স্বাভাবিকভাবেই। যাদের সুপারভাইজিং অফিসার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে দেখা গেছে এরা সবাই অধ্যক্ষ ড: সিদ্ধার্থশঙ্কর নাথের ঘনিষ্ঠ এবং অনুগত বলে পরিচিত। এর চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো ওই কলেজের সুপারভাইজিং অফিসার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল খোদ অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থবাবুর পত্নী শিলচরেরই উইমেন্স কলেজের শিক্ষিকা সংঘমিত্রা দেবনাথকেও। হয়তো ব্যাপারটা বিশেষ দৃষ্টিকটু ঠেকবে এবং সবার নজরে পড়ে যাবে সহজেই, তা ভেবে শেষ পর্যন্ত সংঘমিত্রা কাছাড় কলেজে সুপারভাইজিং অফিসারের ডিউটি করতে যাননি। তবে বিহাড়া বাজারের যুধিষ্ঠির সাহা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিষয় শিক্ষক সুহাষ চন্দ্র দে এবং শিলচর জিসি কলেজের শিক্ষক রাজর্ষি নাথ নামে যে দুজন বর্তমানে কাছাড় কলেজে সুপারভাইজিং অফিসার হিসেবে কাজ করছেন, তারা দুজনও অধ্যক্ষের অতি ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
জানা গেছে সংঘমিত্রা দেবনাথ, সুহাষ চন্দ্র দে, এবং রাজর্ষি নাথ ছাড়া জিতু সইকিয়া নামে জিসি কলেজের অন্য এক শিক্ষককেও কাছাড় কলেজে সুপারভাইজিং অফিসার হিসেবে নিযুক্ত করেছিল পর্ষদ। খবর অনুযায়ী জিতু কিছুদিন আগে অন্যত্র চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। তাই তাঁর কাছাড় কলেজের ডিউটি করার প্রশ্নই উঠে না। আর অধ্যক্ষ পত্নী সঙ্গমিত্রাদেবী তো ডিউটি করতে যাননি। বর্তমানে ডিউটিরত সুহাষ চন্দ্র দে সম্পর্কে জানা গেছে, পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক সুহাষবাবু আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ই কর্মরত ছিলেন অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ নাথ। আর গবেষণার সূত্রে সুভাষ বাবুর সঙ্গে অধ্যক্ষ নাথের তখন থেকেই গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এর চেয়েও বড় ব্যাপার, অধ্যক্ষর যে ভাইপোর নাম নকল কাণ্ডে জড়িয়েছে তাকে নাকি বাড়িতে পড়াতেনও সুহাষবাবু। যদিও এ নিয়ে জিজ্ঞেস করলে সুহাস বাবু অধ্যক্ষের ভাইপোকে পড়ানোর কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তার দাবি তিনি বর্তমানে আর প্রাইভেট টিউশন করেনই না। তবে গবেষণার সূত্রে অধ্যক্ষ নাথের সঙ্গে যে তার সম্পর্ক ছিল একথা স্বীকার করেছেন তিনি। সুহাস বাবু জানান, তিনি যখন পিএইচডি করেন তখন তার গাইড ছিলেন রামেন্দু ভট্টাচার্য। যদিও সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকায় ড: সিদ্ধার্থ শংকর নাথ গবেষণার ক্ষেত্রে তাকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন।
আর রাজর্ষি নাথ জানান, তিনি পিএইচডি করেছেন শিলচর এনআইটি থেকে। সে সময় সিদ্ধার্থ বাবু কর্মরত ছিলেন এনআইটিতে। তার গবেষণার ক্ষেত্রে গাইড হিসেবে ছিলেন অন্য একজন সিনিয়র শিক্ষক। তবে গবেষণার শেষ পর্বে ওই শিক্ষক এনআইটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তখন তিনি তার পেপার “সাবমিট” করেন সিদ্ধার্থ শংকর নাথের অধীনে।
সুভাষ চন্দ্র দে এবং রাজর্ষি নাথের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট অধ্যক্ষ ড: সিদ্ধার্থ শংকর নাথের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল আগে থেকেই। একদিকে পত্নী, এরপর সুপারভাইজিং অফিসার হিসেবে নিযুক্ত অন্য দুজনও অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ। কাকতালীয়ভাবে তিনজনের তিনজনই এভাবে কাছের লোক হয়ে যাবেন তা অনেকের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সন্দেহ করা হচ্ছে, হয়তো কোনওভাবে পর্ষদের কারো সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া করে এই তিনজনকে কাছাড় কলেজে সুপারভাইজিং অফিসার হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
তবে সুহাষবাবু এবং রাজর্ষি বাবুরা জোর গলায় দাবী করেছেন সম্পর্ক থাকলেও অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোনও ভূমিকাই ছিল না। সোমবারের ঘটনা নিয়ে রাজর্ষি বাবু বলেন, পরীক্ষার প্রথম ঘন্টায় তিনি সিক রুমে গিয়েছিলেন। তখন সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। মাঝে কিছুক্ষণের জন্য খাওয়া দাওয়া সেরে যখন তিনি দ্বিতীয় দফায় রাউন্ডে বের হন, তখনই শুনতে পান সিকরুম-এর পরীক্ষার্থীদের নকল করার সময় ধরেছেন ম্যাজিস্ট্রেট।
এদিকে নকল কাণ্ডকে ঘিরে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অসম উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক ও কর্মচারী সংস্থার রাজ্য সভাপতি কৃষ্ণেন্দু রায়। এ নিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, পর্ষদের কড়া ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তেমন কিছুই দেখা যায়নি। কৃষ্ণেন্দু বাবু জানান, ঘটনার পরদিন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এ নিয়ে যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে সবকিছু তিনি নিজে পর্ষদের কর্তা ব্যক্তিদের কাছে পাঠিয়েছেন। আশা করছিলেন পর্ষদ কড়া হাতে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তেমন কিছুই করা হয়নি। তিনি উস্মা ব্যাক্ত করে বলেন, দুজন পরীক্ষার্থীকে নকল করার সময় হাতেনাতে ধরার পরও এদিন যেভাবে ফের পরীক্ষায় বসার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, তা চরম দুর্ভাগ্যজনক এবং দুঃখজনক। তিনি প্রশ্ন তুলেন তবে কি এবার অন্যদেরও নকলে ধরলে ছেড়ে দিতে হবে। এক যাত্রায় তো ভিন্ন ফল হতে পারে না। সঙ্গে তিনি ভাইপো ও আত্মীয়া লিখিতভাবে নকল সরবরাহকারী হিসেবে অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ শংকর নাথের নাম উল্লেখ করার পর এবার তাকে সাসপেন্ড করায় সন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। সঙ্গে অবশ্য এও বলেন, পরীক্ষা ব্যবস্থার প্রতি যাতে সাধারণ লোকেদের বিশ্বাসভঙ্গ না হয় এর জন্য তদন্তক্রমে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।