অনলাইন ডেস্ক : গত বছরের ২০ জুন সকালের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা ভাবলে এখনও শিউরে উঠেন শিলচর শহরের বিভিন্ন এলাকার মানুষ। বেতুকান্দি কাড়ারপারে বাঁধের কাঁটা অংশ দিয়ে ওই দিন সকালে বরাকনদী থেকে তীব্র গতিতে জল ঢুকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল শহরের জনজীবনকে। তাই বেতুকান্দির বাঁধকে ঘিরে এবার সতর্কতায় এবার কোনও খামতি রাখতে চাইছে না প্রশাসন।
২০ জুন বাঁধের কাটা অংশ দিয়ে হু হু করে তীব্র গতিতে জল ঢুকে তাণ্ডবলীলা শুরু করলেও, ওই অংশ দিয়ে নদীর জল ঢুকতে শুরু করেছিল দু’দিন আগে, ১৮ জুন থেকে। এক বছর আগের ঠিক আজকের এই দিনটাতে বরাক নদী বিপদসীমা অতিক্রান্ত করার পরই বাধের কাঁটা অংশ দিয়ে ঢুকতে শুরু করেছিল জল। যা চরম পর্যায়ে পৌঁছে ২০ জুন। গত বছরের সেই ভয়ংকর বন্যার বর্ষপূর্তির লগ্নে এবার বাঁধে যাতে কেউ কোনও ধরনের অপকর্ম করতে না পারে এর জন্য ইতিমধ্যেই ভারতীয় ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৪ ধারার অধীনে জারি করা হয়েছে কিছু নিষেধাজ্ঞা।
১৭ জুন জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। তবে এর কিছুদিন আগে থেকেই সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। আর ১৪৪ ধারা জারির পর তো রীতিমত ক্যাম্প করে সেখানে ২৪ ঘন্টাই চলছে পুলিশি প্রহরা। গত বছর যেখানে বাধ কাটা হয়েছিল, ঠিক সেখানেই তৈরি করা স্লূইসগেটের পাশে নতুনভাবে তৈরি করা বাঁধের উপর প্রায় ২০০ মিটার এলাকা জুড়ে বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। ঘিরে ফেলা এই অংশের মধ্যেই টিন ও ত্রিপল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পুলিশ কর্মীদের দুটি ছাউনি। আর চারপাশে লাগানো হয়েছে লাল পতাকা। এই অংশে সাধারণ লোকেদের কারও পা গলানোর উপায় নেই। অনেকটাই যেন যুদ্ধক্ষেত্র।
অবশ্য শুধু যে ওই অংশেই পুলিশের নজরদারি রয়েছে এমন নয়। নিচে দিয়ে যাওয়া পুরানো বাঁধ যা এলাকাবাসী চলাচলের জন্য রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন, সেই রাস্তা দিয়েও একসঙ্গে চারজনের বেশি লোক যাতায়াত করতে পারছেন না। একটু ভিড় হলেই পুলিশ কর্মীরা গলা উচিয়ে তাদের সেখান থেকে দ্রুত সরে যেতে বাধ্য করছেন। অবশ্য জল ও কাঁদায় খোয়াড়সম হয়ে পড়া ওই নিচের বাঁধ তথা রাস্তার হাল বর্তমানে এমনই যে, মাঝে মাঝে একসঙ্গে কিছু লোক জমে গেলেও বেশিরভাগ সময়ই তা থাকছে জনশূন্য। নিতান্ত বাধ্য না হলে কেউ সে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছেন না, চলাচল করছেন ঘুরপথে।
এদিকে শুধু পুরনো বা নতুন বাঁধেই যে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল রয়েছে এমন নয়। নদীর তীরেও লাল পতাকা টাঙ্গিয়ে সেদিকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না কাউকেই। জানা গেছে, পুলিশকর্মীরা সেখানে প্রহরা দিচ্ছেন তিনি শিফটে। প্রতিটি শিফটে থাকছেন ৬-৭ জন করে পুলিশ কর্মী। আর মাঝে মাঝেই সেখানে গিয়ে সবকিছু নিরীক্ষণ করছেন খোদ পুলিশ সুপার নূমল মাহাতো, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুব্রত সেন থেকে ধরে অন্যান্য পুলিশকর্তারা। পুলিশের এক কর্তা বলেন, গত বছরের অভিজ্ঞতার পর এবার আর তারা কোন ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। জলদানবকে রুখতে বাঁধ সহ স্লূইসগেট ও গোটা এলাকার প্রহরায় কোনও ফাঁকফোকর রাখতে চাইছেন না।
পুলিশের এই প্রহরার মাঝে স্লূইসগেট দিয়ে মহিষাবিলের জল অবশ্য যথারীতি ছাড়া হচ্ছে নদীতে। তবে নদীর জল বেড়ে ডুবিয়ে দিয়েছে গেটের নিকাশী নালার অনেকটাই। জল সম্পদ বিভাগের শিলচর সংমন্ডলের বাস্তুকার কে জামান জানিয়েছেন, রবিবার রাত ৭টায় অন্নপূর্ণা ঘাটে বরাক নদীর জলস্তর রয়েছে ১৭’৩৮ মিটার। যদি জলস্তর আরও দেড় মিটার বেড়ে যায়, তখন বন্ধ করে দিতে হবে গেট। এর আগে পর্যন্ত যথারীতি ছাড়া হবে মহিষাবিলের জল।
এদিকে এসব ডামাডোলের মাঝে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে চরম বিপাকে পড়েছেন এলাকার বাসিন্দারা। ১৪৪ ধারা জারির দরুন একসঙ্গে বেশি লোক চলাচলে নিষেধাজ্ঞায় তাদের কোনও সমস্যা নেই। সমস্যা কর্দমাক্ত রাস্তা নিয়ে। গেটের পাশের নিচের যে পুরনো বাঁধ দিয়ে তারা চলাচল করে থাকেন, সেই বাঁধের অবস্থা এমনই যে কোনও বাহন নিয়ে চলাচল তো বহু দূর, পায়ে হেঁটে চলাই মুশকিল। তাই নিতান্ত বাধ্য না হলে তারা শহরে আসা-যাওয়া করছেন বড়জুরাই, সাংজুরাই হয়ে দীর্ঘ প্রায় ১৫ কিলোমিটার ঘুরে। অথচ এদিকে শহর থেকে তাদের এলাকার দূরত্ব মাত্র দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার।
বেতুকান্দি এলাকায় ক্ষেতের জমি রয়েছে মধুরবন্দের বাসিন্দা দিলওয়ার হোসেন লস্কর ওরফে দারার। রবিবার দুপুরে ক্ষেত থেকে কিছু সব্জি উঠিয়ে তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। কর্দমাক্ত রাস্তায় সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে এগনোর পথে তিনি বলেন, সরকার বন্যা রুখতে কড়া অবস্থান নিয়েছে, এটা খুব ভালো ব্যাপার। তবে আপাতত তাদের চলাচলের সুবিধার জন্য নিচের বাঁধে তো অন্তত কিছুটা পাথর ফেলে দেওয়া যায়। এর চেয়ে তো বেশি কিছু চাইছেন না তারা। দিলওয়ার হোসেনের মতো ওই রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী অনেকেরই মুখে এদিন শোনা গেছে সেই একই কথা।