একান্ত সাক্ষাতকারে গোলাম কুদ্দুস
বাংলাদেশ বাংলা অ্যাকাডেমির ফেলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সেনেট সদস্য, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি লেখক-গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুস শিলচরে এসেছেন একাদশ শহিদ দিবসের অনুষ্ঠানে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের আমন্ত্রণে। ব্যস্ততার ফাঁকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতেই সময় চেয়ে নেওয়া নেওয়া। ‘বিশ্রামের পর কথা হবে’ শুনে তাঁর মমত্ব-মাখা উত্তর ছিল, ‘ সংস্কৃতি-শ্রমিকদের বিশ্রাম নিলে হয় ? বাংলাদেশের এই ‘সংস্কৃতি-শ্রমিক’-র সঙ্গে বরাক ও ওপারের ভাষার লড়াই নিয়ে কথোপকথন ……
মৃত্যুঞ্জয় দাস
মানুষ জন্মের পর ভাষাটাই আগে শেখে, ধর্ম পরে। ভাষা ও ধর্মের কোনটা প্রথম, এই প্রশ্ন দিয়েই কথোপকথন শুরু। এবং তাঁর সোজাসাপটা জবাব ছিল এটাই। এরপরই কথোপকথনের যোগসূত্রে জিজ্ঞাসা, বাংলাদেশের ভাষা সংগ্রামে ধর্ম আদৌ কাজ করেছে কি? ‘কাজ করেছে। তবে বিরুদ্ধে।’ প্রশ্ন পেশ করা শেষ হতে না হতেই গোলাম কুদ্দুসের পরিষ্কার মন্তব্য। এভাবেই প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরের পথ ধরে বরাকের ভাষার লড়াইকে কি দৃষ্টিতে দেখে বাংলাদেশ, কিভাবে দেখেন বুদ্ধিজীবীরা তা জানার আগ্রহ এখানে নেহাত কম নয়। তাই তাঁর মুখে বিষয়টি শুনতে গেলে ওপারের বাংলা অ্যাকাডেমির ফেলো গোলাম কুদ্দুস জানান, একটু বিস্তৃত না বললে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থেকে জেতে পারে। প্রথমত ১৯৪৭-এ ব্রিটিশের হাত থেকে মুক্ত হয়ে ভারত বিভক্ত হল ধর্মের ভিত্তিতে। সেই সময় পাকিস্তানের চৌষট্টি শতাংশ মানুষ ছিলেন বাঙ্গালি। গণতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী এই চৌষট্টি শতাংশের ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা। কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে, ইসলামি পাকিস্তানের কথা বলে বিরোধিতা করে তৎকালীন পাকিস্তানি পশ্চিমি শাসকগোষ্ঠী। সেই কারণেই বলছি ধর্ম বাংলা ভাষার বিরোধিতা করেছিল এবং পরবর্তীতে শাসকগোষ্ঠী ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যভার করেছিল তাদের শোষণ-নির্যাতনের স্বার্থে। কিন্তু পরবর্তীকালে তারা পারেনি।বাঙালি জাতিসত্ত্বারই জয় হয়েছে। শিলচরে বা অসমে ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে বলি, ভাষা আঞ্চলিক নয়, আন্তর্জাতিক এবং সর্বজনীন। পৃথিবীতে যেখানে মাত্র একটি মানুষ একটি মাত্র ভাষায় কথা বলবে, সেটাই তার মাতৃভাষা এবং সে ভাষায় তার কথা বলার অধিকার রয়েছে।এখানে শুধু বাংলা ভাষার জন্য তো নয়, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিরা তাদের ভাষার জন্য শহিদ হয়েছেন। বরাক উপত্যকায় একষট্টির ভাষা আন্দোলন ছাড়াও পরবর্তীতে আরও আন্দোলন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় কোনও ভাষার স্বীকৃতি যদি সরকার না দেয়, সেখানে এই ভাষা নিয়েই জাতিগত সংঘাত বেঁধে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। যেটা বরাক উপত্যকায় বারবার সংগঠিতহয়।আমরা মনে করি বরাক উপত্যকার এই আন্দোলন খুবই ন্যায্য এবং এতে আমাদের পূর্ণ সমর্থন আছে। এটা মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার লড়াই। দ্বিতীয়ত আমরা বাহান্ন সালে রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা কেড়ে এনেছি। সেই লড়াইয়েরই আমাদেরই রক্তের অংশীদার আমাদেরই প্রতিবেশি আরেকটি রাষ্ট্রে, সে-ও বাংলাভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করেছে, সেখানে আমাদের শতভাগ সমর্থন থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আজ রাষ্ট্রসঙ্ঘ আন্ত্রজাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেখানে উনিশে মে বা বরাকের আরও যে ভাষা আন্দোলন হয়েছে তার স্বীকৃতির পক্ষে আমরা। একুশের রক্তস্রোত এবং উনিশের রক্তস্রোত মিলেমিশে সারা পৃথিবীতে বাংলাভাষার মর্যাদাকে সমৃদ্ধ করেছে।
একুশের আন্দোলনের চেতনা থেকেই বাঙালির জন্য পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম। অর্থাৎ, ভাষার লড়াই শুধু ভাষাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেওয়ার ফলশ্রুতিই স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই অর্জন তো হল। এবার তবে বাংলাদেশে ভাষার লড়াই শেষ? এই প্রশ্নের উত্তরে কুদ্দুস বলেন,’না না, শেষ হবে কেন? আমাদের সেই লড়াইয়ের ফলে এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এখন প্রতিনিয়ত লড়াই চলছে এই ভাষার শতভাগ প্রয়োগ।‘ এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলন ছিল পাকিস্তান শাসকের বিরুদ্ধে, আমাদের মাতৃভাষা দাবিয়ে অন্য ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে। এখন দাবি হচ্ছে, বাংলার একশভাগ ব্যবহার।কেবলমাত্র বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই অন্য ভাষা চলতে পারে, অন্যথায় নয়। এ ক্ষেত্রে জাপান, চিন, রাশিয়া, জার্মান ইত্যাদি দেশের উদাহরণ দিয়ে বলেন,’সেসব দেশে তাদের রাষ্ট্রভাষা শেখে তারপর কাজকর্ম করতে হয়। এজন্য নির্ধারিত সময়ের ভাষাশিক্ষার কোর্স করতে হবে। তাহলে আমার নিজদেশে নিজের ভাষা কেন নয় ? ওরা যদি জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা পরিভাষা তৈরি করতে পারে, আমরা কেন পারব না? বাংলাদেশে বাংলা নয় কেন?
আমরা এখন সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আসলে ভাষার লড়াই একটা চলমান লড়াই। আমরা আটচল্লিশ সালে, বাহান্নতে, একাত্তরে ভাষার লড়াইর ফসলকে নিয়েই একটা স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে। স্বাধীন রাষ্ট্রেও এখনও ভাষার লড়াই চলমান। তাহলে প্রেক্ষিতটা কি? ভাষার লড়াই করে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জনের পরেও আবার কেন ? আমাদের দাবি হল, সব ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার। কারণ, এখনও আমাদের দেশে বহু ঔপনিবেশিক আইনকানুন রয়ে গেছে। এখনও বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে ইংরেজি ভাষার প্রচলন রয়ে গেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এখনও বহু জায়গায় ইংরেজি ভাষার প্রচলন। এখনও সরকারি অনেক আধিকারিক ইংরেজি ভাষায়ই … আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এখনও পুরপুরি পরিবর্তন ঘটেনি। আমাদের মানসিকতারও এখনও পরিবর্তন হয়নি। বিনা প্রয়োজনে সাইনবোর্ডে ইংরেজির ব্যবহার চলছে।তাই আমরা লড়ছি শতভাগ বাংলার ব্যবহারের দাবিতে। আর উনিশ সে পথে আমাদেরই সাথী…।