অনলাইন ডেস্ক : সকালে রেল স্টেশন ও শ্মশানঘাটে সমাগমকে ঘিরে যদিও কিছুটা হতাশার সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে দুপুরে গান্ধীবাগে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে বাঁধভাঙ্গা ঢল যেন বার্তা দিয়ে গেল, জারি থাকবে বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার লড়াই । এর চেয়েও বড় ব্যাপার শুক্রবার ১৯ মে শহীদ দিবসে দেখা গেছে আরও এক আশাব্যাঞ্জক চিত্র। বাংলার অন্য তিন ভুবন হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা থেকে বিদ্বজনেরা এসে বরাক উপত্যকার শিলচরে নানা অনুষ্ঠানে সামিল হয়েছেন, এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে উনিশ আর সীমাবদ্ধ হয়ে নেই এই উপত্যকায়। ক্রমেই দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে এই শিলচরের বুকে একাদশ শহীদের রক্তস্নাত বীরগাথার অধ্যায়।
দুপুর ২টা বেজে ৩৫ মিনিট,১৯৬১র ১৯ মে এই দিনটাতেই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে আগ্রাসন রুখতে লড়াইয়ে নেমে শিলচর রেল স্টেশনে ঠিক এই সময়টাতেই পুলিশের গুলির মুখে পড়তে হয়েছিল আন্দোলনকারীদের। এর সূত্র ধরে শহীদ দিবসে ঠিক ওই সময় থেকেই গান্ধীবাগের শহীদমিনারে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন পর্ব শুরু হওয়ার রেওয়াজ চলে আসছে। এদিন আকাশ মেঘলা থাকলেও ২টো ৩৫ মিনিটের অনেক আগে থেকেই একের পর এক ছোট -বড় মিছিল এগোতে থাকে গান্ধীবাগ- অভিমুখে। দেখতে দেখতেই ভরে যায় পুরো গান্ধীবাগ। তাৎপর্যপূর্ণভাবে যাদের সিংহভাগই ছিলেন নবীন প্রজন্মের আর মহিলাদের সংখ্যাও ছিল চোখে পড়ার মতো। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ভিড়ের বহরও। মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, নৃত্য -গীত, আবৃত্তি, চিত্রাংকন ইত্যাদির মাধ্যমে একাদশ শহীদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মাধ্যমে গান্ধীবাগ যেন ফিরে যায় সেই ৬১র আবেগময় দিনগুলোতে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা স্বনামধন্য গায়ক ও গবেষক শুভেন্দু মাইতি, বিশ্ব বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন-২০২৩-এর চেয়ারপারসন ডাঃ পার্থ সারথী মুখার্জি, কবি সেলিম দুরানি, বাংলাদেশের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গুলাম কুদ্দুস, অন্য কর্মকর্তা শামসুল আলম সেলিম, ত্রিপুরার জবা পাল, ঝর্না সাহা, এঅঞ্চলের সঙ্গীতশিল্পী শুভ প্রসাদ নন্দী মজুমদার সহ অন্যান্যদের একের পর অনুষ্ঠান পরিবেশনের মাঝে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে সামিল হতে দেখা যায় অন্যান্য জনগোষ্ঠীর লোকেদেরও। ছিলেন জয়েন্ট একশন কমিটি এগেনস্ট ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড কালচারাল এগ্রেশনের ডা: শান্তি কুমার সিংহ, নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী মহাসভার মহাসচিব স্বপন কুমার সিংহ সহ আরও অন্যান্য কর্মকর্তা।
শুধু গান্ধীবাগই নয়, ক্ষুদিরাম মূর্তির পাদদেশ সহ শহরের অন্যান্য এলাকায়ও শহীদ স্মরণে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত এভাবে গোটা শিলচর শহর জুড়ে ঝরতে তাকে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও আবেগ।
যদিও এর আগে সকালে রেল স্টেশন চত্বর এবং শ্মশান ঘাটে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন পর্বে ভিড় ছিল তুলনামূলকভাবে কম। হয়তো আকাশের মেঘলা ভাব এর জন্য অনেকটা দায়ী হলেও এতে সেসময় ভাষাপ্রেমীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে কিছুটা হতাশা। শ্মশান ঘাটে তুলনামূলকভাবে কম ভিড় দেখে নিজেদের হতাশা লুকিয়ে রাখতে পারেননি আমরা বাঙালির সাধন পুরকায়স্থ, নাট্যকার চিত্রভানূ ভৌমিকরা। কেউ কেউ মন্তব্য করেন, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিদ্বজনেরা এসে উনিশ উদযাপনের জন্য আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, আর আমরা কিনা নিজেরাই এগিয়ে আসতে নারাজ। তবে পরবর্তীতে গান্ধীবাগ সহ গোটা শহরের চিত্র যেন অতিরিক্ত অক্সিজেনের সঞ্চার ঘটিয়ে সবার মুখে ফুটিয়ে তুলে হাসি।
রেল স্টেশন চত্বরে ভাষা শহীদ স্টেশন শহীদ স্মরণ সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উন্মোচন করা হয় গোলাম কুদ্দুসের লিখা
বই ” বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন”। উন্মোচনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০১৭ সালে তিনি বরাক উপত্যকায় ১৯শে মে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। তখনই তার মনে হয়, উনিশ উদযাপন কেন সীমাবদ্ধ থাকবে শুধু বরাক উপত্যকার মধ্যে। তাই বাংলাদেশে ফিরে উদ্যোগ নেন সে দেশেও উনিশ উদযাপনের। বর্তমানে বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হচ্ছে উনিশ। অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিধায়ক দীপায়ন চক্রবর্তী, বাবুল হোড় প্রমূখ।
স্টেশন চত্বরের অনুষ্ঠানের পর শুরু হয় শ্মশান ঘাটে গিয়ে শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পালা। ভিড় তুলনামূলকভাবে কম হলেও সেখানে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে দেখা যায় রাজ্যসভা সাংসদ সুস্মিতা দেব, বিধায়ক দিপায়ন চক্রবর্তী সহ মর্নিং ক্লাব, এ আই ডি এস ও, বেঙ্গলি ফরোয়ার্ড ক্লাব, আগরতলার ভারত- বাংলাদেশ মৈত্রী সংসদ, ডি ওয়াই এফ আই, এস এফ আই, আইপিটিএ, আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা সংস্কৃতি সমিতির কলকাতা শাখা, নাগরিক স্বার্থ রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ ও ইয়াসি ইত্যাদি সংস্থা সংগঠনের সদস্য এবং ছোটলাল শেঠ ইনস্টিটিউট, নরসিং হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল ও বিবেকানন্দ সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলের পড়ুয়াদের। ব্যক্তিগতভাবেও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন অনেকে।