ভাষা শহিদ দিবস
চন্দন ভৌমিক
আসামের শিলচর শহর তথা বরাক উপত্যকার প্রায় ৯০ শতাংশ বাংলাভাষীদের বসবাস এবং সহকারী সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা স্বীকৃত। এহেন পরিসংখ্যানের পরও আসামের শাসকশ্রেণি বারবার চেষ্টা করে চলেছে ভাষিক আক্রমণের! এমনই এক জঘন্য আক্রমণ সংগঠিত হয় ১৯৬১ সালের ১৯শে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে এবং ১১জন নিরস্ত্র সত্যাগ্রহী তরতাজা প্রাণের বলিদান দিতে হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তথা রাজ্য সরকারের পুলিশের ছোঁড়া বুলেটের সামনে!
তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা নেতৃত্বাধীন আসাম সরকার ১৯৬১র এপ্রিল মাসে ভাষা সার্কুলার জারি করেন এবং ৯০ শতাংশ বাংলাভাষী বরাক উপত্যকায় (বর্তমান তিন জেলা – কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি) বাংলা ভাষা উঠিয়ে অসমীয়া ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার অগণতান্ত্রিক সার্কুলার জারি করে। এই সার্কুলার বাতিল করার দাবিতে মে মাসজুড়ে বরাক উপত্যকার বিভিন্ন শহর ও গ্রামাঞ্চলে তীব্র জনমত তৈরি হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯শে মে বরাক উপত্যকার সর্বত্র প্রতিবাদ দিবস পালন করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এই প্রতিবাদ কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহীরা রেললাইনের উপর বসে পড়ে। বেলা প্রায় ১টার সময় আসাম সরকারের প্ররোচনায় ও জেলাশাসকের নির্দেশে নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের উপর গুলি চালিয়ে এগারো জন তরতাজা প্রাণের সংহার করে। এই ১১ জন শহিদ হলেন- কমলা ভট্টাচার্য, কানাইলাল নিয়োগী, তরণী দেবনাথ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, হিতেশ বিশ্বাস, কুমুদ দাস, চন্ডীচরণ সূত্রধর, শচীন্দ্র পাল এবং সত্যেন্দ্র দেব। এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বরাক উপত্যকা সহ পশ্চিমবাংলা এবং দেশের বিভিন্ন স্হানে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তীব্র প্রতিবাদের মুখে আসাম সরকার এই কুখ্যাত ভাষা সার্কুলার প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে করিমগঞ্জে বাচ্চু চক্রবর্তী এই আন্দোলন করতে গিয়ে শহিদ হন। ১৯৮৬ সালে অগপ নেতৃত্বাধীন সরকার আসাম সরকার আবারো এই ভাষা সার্কুলার জারি করে এবং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহন্তের উপস্থিতিতে ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই করিমগঞ্জে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাস। ১৯৬১র এই এগারোজন শহিদের মধ্যে উত্তর ত্রিপুরার ও দুজন ছিলেন। একইভাবে ১৯৮৬ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষার দাবিতে পাথারকান্দিতে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সুদেষ্ণা সিনহা।
আমাদের দেশে ৩৯৮টা পঞ্জীকৃত ভাষা এবং অপঞ্জীকৃত অনেক ভাষা আজ অস্তিত্ব সংকটের মুখে। ভারতবর্ষে প্রতি ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে ভাষার পরিবর্তন দেখা যায়। ভাষা সন্ত্রাস বা সংখ্যাগরিষ্টের ভাষা অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার সমস্যা ভারত তথা বিশ্বজনীন সমস্যা। ক্রমাগত সংখ্যাগরিষ্টের ভাষা আমাদের মনোজগতে সুচতুর ভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে আর রাজনৈতিক বা সামাজিক কারণে আমরা নিজের ভাষা সংস্কৃতি ভুলে সংখ্যাগরিষ্টের ভাষা বা বুলি নিজের সজ্ঞানে বা অজান্তে বলতে ও অভ্যাস করতে বাধ্য হচ্ছি। কোনও ভাষার প্রতি বিদ্বেষ না রেখে সকল ভাষাকে যথাযথ সম্মান জানিয়ে নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটুক এবং বজায় থাকুক এটাই ১৯শে মের অঙ্গীকার হওয়া উচিত। আমি চাই সাঁওতাল তার ভাষায় কথা বলুক রাষ্ট্রসঙ্ঘে।
আমার বর্তমান কর্মস্হান ও বাসস্থান আগরতলায় হলেও পিতার কর্মস্হান এবং শহিদের রক্তস্নাত শিলচরে আমার জন্ম ও পড়াশোনা। প্রতিবার ১৯শে ভোরবেলায় চলে যেতাম রেলওয়ে স্টেশন চত্বরে, সারাদিন বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতাম। ১৯৯৬ সালে পাকাপাকি ভাবে আগরতলায় চলে আসার পর ১৯শে মের কর্মসূচি আগরতলায় তেমন দেখা যেত না। ২০০৩ সালে পুরাতন রবীন্দ্র ভবনের আম্রকুঞ্জের তলায় শহিদবেদী বসিয়ে তৎকালীন শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রী অনিল সরকার এবং প্রয়াত ভুবন বিজয় মজুমদার সহ অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিকে নিয়ে ১৯শে মের শহিদ দিবস পালন করি। পরবর্তীতে বেশ কিছু সংগঠন আগরতলায় ১৯শে মের কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও পালন করে চলেছে। আগামীতে ১৯শে মে আরও বৃহৎ আকারে পালন হোক, এই কামনা করছি।