অনলাইন ডেস্ক : বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক দিন আজ। শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এই দিনকে সারা বিশ্বে একযোগে ‘মহান মে দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা শ্রমের উপযুক্ত মূল্য ও দৈনিক অনধিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ওই দিন আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে অনেক শ্রমিক হতাহত হন। তাঁদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টা করার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর পর থেকে দিনটি মে দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
কিন্তু দিনটির এই নামকরণই এখন মস্তবড় চ্যালেঞ্জের মুখে। লাগাতার অটোমেশন অর্থাৎ মানুষের পরিবর্তে মেশিনকে উৎপাদন প্রক্রিয়ার মূল চালিকা শক্তি করে তোলায় শিল্পের সঙ্গে শ্রমিকের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক অনেক আগেই ধাক্কা খেয়েছে।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু পদক্ষেপ যা শ্রমিকের সঙ্গে অধিকারের সম্পর্ককেই নিশানা করা হয়েছে। ছেদ ঘটানো হয়েছে এই সম্পর্কে। ফলে ১ মে, যে দিনটি শ্রমিকেরা অধিকার অর্জনকে উদযাপন করে আসছিলেন বিগত বেশ কিছু বছর যাবৎ তা হরণের বিলাপ দিবসে পরিণত হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির সরকার অধিকারকে কী চোখে দেখে, তা শুধুমাত্র শ্রম ক্ষেত্রে তাদের তথাকথিত ঐতিহাসিক সংস্কারে চোখ বোলালেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। তারা দেশের ৪৪টি শ্রম আইনকে এক জায়গায় নিয়ে এসে চারটি লেবার কোড চালু করেছে। সেগুলি হল— এক) মজুরি সম্পর্কিত নিয়মাবলী। দুই) সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও কাজ সম্পর্কিত নিয়মাবলি। তিন) সামাজিক নিরাপত্তা সম্পর্কিত নিয়মাবলি। চার) শিল্প-শ্রমিক সম্পর্কজনিত নিয়মাবলি।
স্বাধীন ভারতে ৭৫ বছরে ধাপে ধাপে শ্রম আইন অজস্রবার সংশোধন করা হয়েছে। একথা ঠিক যে, শ্রমিকরা সাধারণভাবে অনেক ক্ষেত্রেই বিগত সরকারগুলির থেকে সুবিচার পায়নি। কিন্তু বর্তমানে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার শ্রম আইন পরিবর্তন করে লেবার কোড চালুর মাধ্যমে শ্রমিকদের মুখ্য অধিকারগুলি কেড়ে নিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শ্রমিকদের উপর এমন আঘাত এবং ষড়যন্ত্র কোনও নির্বাচিত সরকার করেনি।
বেতন সংক্রান্ত শ্রম কোডে বলা হয়েছে, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে যে চালু ব্যবস্থা রয়েছে তা তুলে দিয়ে টাইম রেট অর্থাৎ (সময় নির্ধারিত কাজ) ও ফুরনপ্রথায় কাজ (পিস রেট)-এর ভিত্তিতে করা হবে। তুলে দেওয়া হল দক্ষতার মাপকাঠি।
মজুরি কোডের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার ফ্লোর লেভেল মজুরি নির্ধারণ করেছে ৪৬২৮ টাকা। অর্থাৎ দিনে ১৭৮ টাকা। বলা হয়েছে এর নীচে কোনও রাজ্যে মজুরি নির্ধারণ করা যাবে না। মজুরি নিয়ে ভয়ঙ্কর এই অমানবিক সিদ্ধান্ত সমস্ত নিয়ম-নীতি আইন-কানুনকে অগ্রাহ্য করে কর্পোরেট পুঁজিপতিদের নির্লজ্জ স্বার্থরক্ষায় করা হয়েছে। অথচ মোদি সরকার নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ ছিল মজুরি হোক দৈনিক ৩৭৫ টাকা থেকে ৪৪৭ টাকা। মাসিক হিসেবে ১১ হাজার ৬২২ টাকা। এসব মানা হয়নি। তার বদলে ফ্লোর রেট করা হল দিনে ১৭৮ টাকা।
শ্রমিকদের জন্য বিপদজনক শিল্পকারখানা এবং স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা আছে এমন উৎপাদন প্রক্রিয়া চিহ্নিত করা ছিল। তা তুলে দেওয়া হয়েছে। কাজের জায়গায় স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও নিরাপত্তার বিষয়টি স্থির করার অধিকার পুরোপুরি সরকারের। পানীয় জল, টয়লেট, ক্রেস, ক্যান্টিন, ইত্যাদি আবশ্যিক বিষয় আর মালিকদের উপর বাধ্যতামূলক নয়। এগুলি সরকারের সদিচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার লেবার কোড চালু করে স্থায়ী চাকরির ধারণাটাও বদলে দিয়েছে। সরকারি চাকরিও এর বাইরে নয়। ছয় মাসের মেয়াদে চাকরি হবে। শ্রম কোডে শ্রমিকদের দরকষাকষির কোনও সুযোগ রাখা হয়নি। ইউনিয়নের কর্মকর্তা ঠিক করবে মালিকেরা। কর্মী ছাটাইয়ে বিপুল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মালিকদের। ৩০০ জনের বেশি কর্মচারী আছে এমন সংস্থাতেই কর্মী ছাটাই, লে অফ ইত্যাদির আগে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। ঠিকা, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকেরা এর আওতায় আসবেন না। তাদের যখন ইচ্ছে মালিক বসিয়ে দিতে পারবে।
ভারতে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়নের বয়স শতবর্ষ পেরিয়ে গেল। আর এই সময়ই স্বাধীনতা পরবর্তী অর্জিত শ্রমিকের অধিকার আইন করে কেড়ে নেওয়া হল। অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়নের আপত্তি অগ্রাহ্য করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি কেন্দ্রীয় সরকার প্রবর্তিত লেবার কোড চালু করেছে। এতে অবশ্য বিস্ময়ের কিছু নেই। আশ্চয্যের হল, কংগ্রেস সহ অন্যান্য বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলিও শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী লেবার কোড চালু করতে রুলস তৈরিতে উদ্যোগী হয়েছে।
শ্রমিকের আট ঘণ্টা কাজ—যে ঐতিহাসিক অধিকার অর্জনকে সামনে রেখে মে ডে উদযাপন তা আজ সোনার পাথর বাটি বলা চলে। এ বারের মে দিবসে শ্রমিকের অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ট্রেড ইউনিয়নের পাশাপাশি নাগরিক সমাজেরও সরব হবে, এটাই সময়ের দাবি।