অনলাইন ডেস্ক : ভারতের প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার নামে সুদূর অস্ট্রেলিয়াতে বড় ধরণের একটি প্রতারণা ধরা পড়েছে। আর এই কুকাণ্ড করেছেন অধুনা শিলচরের বাসিন্দা প্রবাসী অস্ট্রেলিয়ান অম্বরজিৎ এন্দো ওরফে রনি। ঘটনাটি প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সারির সংবাদপত্র ‘দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ এবং ‘দ্য এজ’। প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, অম্বরজিৎ ভারত সরকারের গ্রামীণ সড়ক প্রকল্প রূপায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বন্ড কেনার কথা বলে সেদেশে দেদার অর্থ সংগ্রহ করেন। ছয় মাসে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ রিটার্ন দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সিডনির প্রথম সারির প্রায় ৬০ জন বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করেন তিনি। কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪৯৭ কোটি টাকা) সংগ্রহ করে গত বছরের ডিসেম্বরে অম্বরজিৎ সিডনি থেকে পালিয়ে যান। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকেই সিডনির নিউ সাউথ ওয়েলস এবং ভিক্টোরিয়া পুলিশের কাছে প্রতারণার মামলা দায়ের করেছেন। দুই রাজ্যের পুলিশ তদন্ত চালিয়ে বহু তথ্য সংগ্রহ করেছে।
খবর অনুযায়ী, ইনফোসিসে একজন বিশ্লেষক হিসেবে সিডনিতে কর্মজীবন শুরু করেন শিলচরের অম্বরজিৎ ওরফে রনি। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ পরামর্শদাতা ও হিসাবরক্ষক সংস্থা ‘ডেলয়েট’-এর অংশীদার হয়ে সিনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে দীর্ঘ ১৩ বছর কাজ করার সুবাদে দেশের সেরা বিনিয়োগকারীদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। তবে ‘ডেলয়েট’-এ থাকাকালীন অম্বরজিৎ নিজের প্রতারণার ফাঁদ সৃষ্টি করেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব সংস্থা ‘এন্দো ফ্যামিলি ক্যাপ ট্রাস্ট’। ২০২১ সালে ‘ডেলয়েট’ ছেড়ে তিনি অন্য সংস্থা সায়ার্স গ্রুপে যোগ দেন। কিন্তু সেখান থেকে ছয়মাস পরই তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভারত সরকারের কথিত বন্ড কেনার জন্য ভুয়ো প্রকল্প তৈরি করেন। এতে তাঁর পুরনো দুটি সংস্থার নামীদামী এবং বিশ্বাসী কয়েকজন বিনিয়োগকারীকেও পাশে পেয়ে যান। তাঁরাও অম্বরজিতের সংস্থায় অর্থ লগ্নি করেন। সবার বিশ্বাস ছিল, ভারত সরকারের উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে আখেরে লাভবান হওয়া যাবে। তাই অনেকেই অম্বরজিতের প্রস্তাব এবং ছায়া-প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগে রাজি হন। পরে সেই ‘ডেলয়েট’ কর্ণধার সহ অন্যান্যদের নাম ভাঙিয়ে গোটা অস্ট্রেলিয়া থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে থাকেন অম্বরজিৎ।
‘দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ এবং ‘দ্য এজ’ জানিয়েছে, ঘটনার তদন্তে নেমে তারা অম্বরজিতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের জালিয়াতির হদিশ পেয়েছে। সম্পূর্ণ ঝুঁকিহীন এবং বিপুল আয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করেন। ২০১৯ সালে অম্বরজিতের এ সংক্রান্ত প্রোফাইলে তিনি উল্লেখ করেন, ভারতে তাঁর পারিবারিক ব্যবসা অত্যন্ত ভালভাবে চলছে। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার কাজে দেশের প্রথম তিন ঠিকাদার সংস্থার একটি তাদের। এককথায় এই প্রকল্পে লগ্নিতে যে কোনও ঝুঁকি নেই সেটা বিভিন্ন ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের লোভনীয় রিটার্নের অফার করেন অম্বরজিৎ। প্রোফাইল অনুযায়ী, যারা ৫০ হাজার ডলার দেবেন তাদের ছয়মাস পরে ২০.১২ শতাংশ হারে সব টাকা ফেরত দেওয়া হবে। যারা এক মিলিয়ন ডলারের এক চতুর্থাংশের বেশি বিনিয়োগ করবেন, তাদের ৩৯.০২ শতাংশ হারে রিটার্ন দেওয়ার গ্যারেন্টি দেন তিনি। আর সব লেনদেন হয় অস্ট্রেলিয়ার চারটি বড় ব্যাঙ্কের মাধ্যমে।
গোটা কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পর নিদৃষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে সিডনি পুলিশ তদন্তে নামে। অন্যদিকে বড়মাপের কয়েকজন বিনিয়োগকারী বেসরকারি তদন্তকারী সংস্থা ‘ডাস্কটন হিল’কে এই কান্ডের তদন্ত এবং অম্বরজিতের কাছ থেকে খোয়া যাওয়া অর্থ খুঁজে বের করতে নিয়োগ করেন। সংবাদ মাধ্যমকে ডাস্কটন হিল-এর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে সেদেশের চারটি ব্যাঙ্ক থেকে অম্বরজিৎ সব টাকা ট্রান্সফার করে নিয়েছেন। এমনকি গোটা অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এই ইস্যুতে অস্ট্রেলিয়া সরকার ভারত সরকারের কাছে ইতিমধ্যে সাহায্য চেয়েছে।
অম্বরজিৎ সিডনি থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার পর তাঁর খোঁজ নিতে গিয়ে তদন্তকারী অফিসারেরা বেশ কিছু তথ্য জানতে পেরেছেন। তাঁর বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ছিল চোখে পড়ার মতো। অম্বরজিৎ কোরিয়ান স্ত্রী মিনহি এন্দো সহ দুই সন্তানকে নিয়ে সিডনির ডেল্টা গুডরেমের কাছে সিডনি এপার্টমেন্টে বাস করতেন। ছিল একটি কালো পোরশে গাড়িও। তিনি গা ঢাকা দেওয়ার পর এখন সেই বাড়িটির দখল নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন এটি ভাড়া দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে অনলাইনে বিজ্ঞাপন করেছে।
অম্বরজিতের প্রতারণা শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ভারতেও সেই জাল বিস্তার করেন তিনি। নয়াদিল্লির বাসিন্দা মেহেরজিৎ শাহ নামে একজন গৃহবধূ সামাজিক মাধ্যমে কয়েকদিন থেকে অম্বরজিতের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার চালাচ্ছেন। বিভিন্ন পোস্টে তিনি লিখেছেন,
‘অম্বরজিৎ এন্দো নামে শিলচরের এক ব্যক্তি সম্পর্কে আমি সবার সঙ্গে একটি বিরক্তিকর গল্প শেয়ার করে চাই। তাঁর ডাক নাম রনি। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় একটি ভুয়ো প্রকল্প চালিয়ে মানুষের কাছ থেকে ৬০ মিলিয়ন ডলার চুরি করেছেন। আমিও ভুক্তভোগীদের একজন…… অম্বরজিৎ প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় বিনিয়োগ করতে প্ররোচিত করেছিলেন। এখনও এই কেলেঙ্কারি চলছে। তাই আমি অম্বরজিৎ ও তাঁর স্ত্রী মিনহি সম্পর্কে আপনাদের সতর্ক করতে চাই। তাদের বিশ্বাস করে কেউ অর্থ বিনিয়োগ করবেন না। তাদের ধরতে আমাকে সাহায্য করুন। ছবি দেখে যদি কেউ চিনতে পারেন, বা কোথাও দেখতে পান, তাহলে একটি বার্তা দিন।’