লাইভ খেলা দেখার সৌভাগ্য কখনও হয়নি। কথায় – বার্তায়, আলাপ -আলোচনায়, নিন্দায় – প্রশংসায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে ভদ্রলোকের নাম। হ্যাঁ, ফুটবলের মত খেলাতেও থেকে নিতান্তই ‘ জেন্টলম্যান ‘। ঠোঁটের ফাঁকে মনভোলানো হাসি আর দেখা যাবে না। হাতি ঘোড়া পালকিতে চড়েই অন্যলোকে পাড়ি দিলেন ‘ ফুটবলের রাজা ‘। খেলা শেষের ‘বিরামে ‘ এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে থাকবেন পেলে।
পেলে নাকি পোস্টের মাপ জানতেন, যখন দৌড়তেন বনের হরিণরাও নাকি লজ্জা পেয়ে যেত!! বাবা, জ্যাঠাদের মুখে এসব ‘রূপকথার ‘ কাহিনী শুনে শুনে বড় হয়ে উঠা। ব্রাজিলিয়ান সুরকারের নান্দনিক ফুটবল ধারায় স্নান করার সুযোগটা ঘটেনি আমাদের মত অনেক অভাগার। অন্তর্জালের ফাঁকে যা কিছু চোখে পড়েছে আর কি। ফুটবলীয় অভিধানের বিচারে তাতেই অমৃতলাভ। কিছু একটা ছিল বলেই তো লোকটাকে নিয়ে এত কথা, এত আলাপ, এত আলোচনা। আবেগের বশে হয়তো আর্জেন্টিনার আরেক হিরে মারাদোনার সঙ্গে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের শিরোপা ভাগ করতে হয়েছে। নইলে প্রায় একক দক্ষতায় তিন তিনটি বিশ্বকাপ জেতানোর পর কারোর প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। ১৯৫৮-১৯৭০ পর্যন্ত চারটি বিশ্বকাপ খেলে ৩টিতেই চ্যাম্পিয়ন হন পেলে। বিশ্বকাপে ১৪ ম্যাচে করেন ১২ গোল।
দারিদ্র্যের কারণে ছোট বয়সে চায়ের দোকানে কাজ নিতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু হৃদয়ে ছিল ফুটবল। ব্রাজিলের আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই গলির ফুটবল ছিল তারও অবসরের সঙ্গী। কিন্তু সত্যিকারের ফুটবল কেনার টাকা ছিল না বলে মোজার ভেতরে খবরের কাগজ ঠেসে বানানো ফুটবলে চলত তার অনুশীলন। তবে পেলের ছিল সহজাত প্রতিভা।
ব্রাজিলকে বিশ্বকাপে তিন বার তিনি চ্যাম্পিয়ন করেছেন। তাঁর পায়ের জাদুতে এখনও মন্ত্রমুগ্ধ বিশ্ব। তাঁকে একবার দেখার জন্য আকুল কোটি কোটি মানুষ।
১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে ফাইনালে উঠলেও ব্রাজিলকে ফুটবল বিশ্ব চিনেছে পেলের নামেই। কালো মানিকের প্রাইম টাইমেই সাম্বার পরিচিতি লাভ হয়। কিংবদন্তির যাত্রা হচ্ছে সৃষ্টিশীল পুনর্জন্মের প্রতিচ্ছবি, আমাদের অভ্যন্তরের পরিবর্তনের চিরন্তন চক্র।ব্রাজিলের এক গরিব ঘরে জন্ম নেওয়া এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো নামের বালকের গল্পটার চেয়ে মোহনীয়, বৈশ্বিক কিংবদন্তির যাত্রার আর কোনো উদাহরণ নেই। তিনি এমনই এক মোহমায়া, যারা আবেশে বুঁদ হয়ে ছিল গোটা দুনিয়া। এর আগে হয়তো এই বসুন্ধরা স্নাত হয়েছে বহু বীরের সিক্ত গাথায়, কিন্তু গোটা পৃথিবী নতজানু হয়ে সম্মান জানিয়েছে, ভালোবাসায় আপন করে নিয়েছে, আত্মার আত্মীয় হিসেবে মেনে নিয়েছে—তা হয়নি। পেলের উত্থানটা এমন এক সময়ে, যখন বিশ্ব দেখছে সবচেয়ে উত্তাল শতকের সবচেয়ে টালমাটাল সময়টা। বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবে ক্ষত–বিক্ষত দুনিয়া আর মানবতা খুঁজতে চাইছে এমন কিছু, যাতে তার বিভেদ আর ধংস ভুলে নতুন যুগের দুনিয়ায় সাম্য আর সম্প্রীতির সুর পাওয়া যায়। জাতি ও ধর্মের বিভেদের যে ভয়ংকর রূপে বিশ্ব, ঘৃণার চাষের যে তাণ্ডবলীলায় দুনিয়া ছাড়খাড় হলো, তখন সে মরিয়া এক কিংবদন্তির খোঁজে।
আবার প্রযুক্তির উৎকর্ষে বিশ্বায়ন তখন অবধারিত। কথা বলছে কালো -সাদা নিয়ে। ফলে, সেই কিংবদন্তিকে হতে হবে এমন, যিনি একাধারে মানুষকে বিভেদ ভুলিয়ে দেবেন আবার মানুষের ক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু দেখিয়ে নতুন দুনিয়ায় উজ্জীবিত করবেন এগিয়ে যাওয়ার যাত্রায়।মানুষের ইতিহাসে বারবার যেমনটা দেখা যায়, সময়ের পরীক্ষা যত কঠিনই হোক, সে ঠিকই উতরে যায়। নায়কের যাত্রা সময়কে সামনে নিয়ে যায়।
পেলেও ঠিক তা–ই করলেন। এক শতক আগেও যে খেলা লোকে তেমন একটা চিনত না, সেই ফুটবল তত দিনে জনতার খেলা হয়ে উঠেছে। সেই ফুটবলে ভর করে তিনি হয়ে উঠলেন সময়ের নায়ক। ঠিক যেমনটা সে সময় দরকার ছিল। ফুটবলে হয়তো জনতা দুই ভাগ হয়ে খেলা দেখে, কিন্তু পেলের মতো মহানায়কেরা শুধু মাঠ নয়, মাঠের বাইরের ভেদাভেদও ভুলিয়ে দেন।
শুধু কি ভক্ত, নিন্দুকদের মনেও লোকটার জন্য অনেক স্পেস ছিল। তর্কে – বিতর্কে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ মারাদোনাকেও একদা বলতে শুনা গেছে, পেলে নাকি শরীরের যে কোনো অংশ দিয়ে গোল করতে পারেন। এক কিংবদন্তীর মুখে আরেকজনের প্রশংসা। সত্যিই তাই। পেলে হচ্ছেন সময়ের সেই মহানায়ক, যিনি মায়াজগতের গভীর গহিনে আবিষ্কার করেছেন পরবর্তী সময়ের পাথেয় হয়ে। ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর দেশের কিংবদন্তী ইউসেবিও তো একদা বলেছেন, পেলে হলেন ঈশ্বর প্রেরিত প্রতিভা।
ফুটবলের মানচিত্রে ব্রাজিল যে জায়ান্টের স্থান পেয়েছে এর অন্যতম ছিলেন পেলে। তবে সেই পেলে আজকের পেলে তো আর একদিনে হয়ে যাননি। পুরো ব্যাপারটাই কঠোর নিয়ম, সাফল্যের আকাঙ্ক্ষা আর পরিশ্রমের গল্প। লটারি জেতার মতো রোমান্টিক নয়। পেলের কিংবদন্তিটা রোমান্টিক হলেও, তাঁর উত্থানটা আসলে সমাজবিজ্ঞানের এই কঠোর বাস্তব বিশ্লেষণ দিয়েই বুঝতে হবে। কিংবদন্তিও তৈরি হন সঠিক সময়ে, সঠিক স্থানে থাকার কারণে।
পৃথিবীর বুকে এত এত দেশ! কে কাকে এত মনে রাখে! কার এত দায়! তবুও মানুষ যে কটি দেশের কথা বুঝতে শেখার পর থেকে সবচেয়ে বেশি শোনে, তার একটি ব্রাজিল। কারণ, আর কিছু নয়—ফুটবল। মানুষের অস্ত্বিত্বের সঙ্গে মিশে যাওয়া একটি নাম। বলে লাথি মেরে শৈশব শুরু করেনি এমন মানুষ–ই বা কজন আছে! আর এসবের ভেতর মিশে আছে একটি নাম—পেলে। যে মানুষ কখনো পেলের খেলা দেখেনি, তাঁর কাছেও এই নাম গভীর আবেগের।
আপাতত স্ট্রাইকিং জোনে নয়, শান্তিতে শুয়ে রয়েছেন চার বাই ছয় ফুটের একটা বাক্সে। ঢিমেতালে রওনা হবেন অন্যলোকের সফরে। বিশাল আকাশ, কিন্তু তার চেয়ে বিশালত্ব নিয়ে যে মানুষ পৃথিবীকে পা দিয়ে শাসন করে গেছেন, তাঁর ভার সামলানোর সামর্থ্য সেই আকাশের আছে কি? কে জানে, পৃথিবীর উজ্জ্বলতম নক্ষত্রকে ধারণ করার শক্তি দূর আকাশের আছে কি না! আকাশের হিসাব যদিও আমাদের অজানা, তবে মর্ত্যেরটা আমরা জানিই। যে কিনা সবচেয়ে দামি কোহিনূরটি হারিয়ে গেল , আর কখনো ফিরবে না তা। সবশেষে ধন্যবাদ পেলে, আমাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য।