পরীক্ষার নম্বর কম পাওয়ার বিষয়ে আলোচনার বাহানায় দ্বিতীয় সেমিস্টারের এক ছাত্রীকে নিজের কার্যালয়ে ডেকে যৌন হেনস্থা করলেন শিলচরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এনআইটি)-র ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কোটেশ্বর রাজু ধেনুকন্ডা। ছাত্রীর বয়ান অনুযায়ী, ঘটনাটি ঘটেছে বৃহস্পতিবার বিকেলে। খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই পড়ুয়াদের প্রতিবাদে উত্তাল হয় গোটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরিস্থিতি সামাল দিতে অভিযুক্ত অধ্যাপককে বরখাস্ত করা হয় এবং শুক্রবার সন্ধ্যায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ছাত্রীটি তার সঙ্গে হওয়া ঘটনার বিবরণ একটি কাগজে লিখে প্রথমে শিলচর এনআইটির ছাত্র সংসদের কাছে বিষয়টি জানায় এবং পরবর্তীতে এটি কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হয়। কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমেও এটি তুলে ধরেন এবং খবরটি দাবানলের মতো গোটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছড়িয়ে পড়ে। রাত বারোটা নাগাদ ছাত্রছাত্রীরা তাদের হোস্টেল থেকে বেরিয়ে আসে এবং ভোর চারটে পর্যন্ত চলে তাদের প্রতিবাদ। শেষমেষ কর্তৃপক্ষের তরফে তাদের আশ্বাস দেওয়া হয়, ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং ছাত্রীর পাশে তারা রয়েছেন। কর্তৃপক্ষের আশ্বাসকে সম্মান জানিয়ে ছাত্রছাত্রীরা আপাতত প্রতিবাদ বন্ধ করে এবং শুক্রবার সকালে ডিরেক্টর দিলীপ কুমার বৈদ্য একটি বৈঠক আয়োজন করেন।
বৈঠকের পর রেজিস্ট্রার অসীম রায়কে সঙ্গে নিয়ে তিনি জানান, দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীর অভিযোগের উপর ভিত্তি করে তারা আপাতত কোটেশ্বর রাজু ধেনুকন্ডাকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করেছেন এবং প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ কমিটি (আইসিসি) এব্যাপারে তদন্ত করছে। অসীম রায় বলেন, ‘আমরা ছাত্রীর কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি এবং সঙ্গে সঙ্গেই অভিযুক্তকে বরখাস্ত করা হয়েছে। যদিও তাকে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়নি, ফলে আমরা বিভাগের প্রধানের কাছে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি। তিনি বিষয়টি সরাসরি দেখবেন। যে কক্ষে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি তদন্তের খাতিরে আপাতত সিল করে দেওয়া হয়েছে। আমরা ছাত্রীর পাশে রয়েছি এবং সে যে সিদ্ধান্ত নেবে এতে আমাদের সহায়তা থাকবে।’ এদিকে সামাজিক মাধ্যমে এক ব্যক্তির পোস্টে উত্তর দিয়ে অসম পুলিশের কর্তৃপক্ষ কাছাড় পুলিশকে নির্দেশ দেন, তারা যেন অতিসত্বর বিষয়টি তদন্ত করেন। এরপরেই পুলিশের একটি দল এনআইটিতে উপস্থিত হয় এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর ছাত্রী এবং তার পরিবারের লোকেরা দুটো মামলা করেন। এর উপর ভিত্তি করে পুলিশ কোটেশ্বর রাজু ধেনুকন্ডাকে তার কোয়ার্টার থেকে তুলে আনে এবং সদর থানায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশ সুপার নুমাল মাহাত্তা জানিয়েছেন, তারা প্রথমে অভিযুক্ত অধ্যাপককে আটক করেন এবং প্রাথমিক তদন্তের পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। ছাত্রীটি তার বিবরণে জানিয়েছে, সে তার প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষায় একটা বিষয়ে কম নম্বর পেয়েছিল এবং এনিয়ে খুব বেশি চিন্তায় ছিল। কোথায় ভুল হচ্ছে এই ব্যাপারে শিক্ষকদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলোচনাও করেছে সে। ছাত্রীটি লিখেছে, ‘বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আমাকে তার কার্যালয়ে ডেকে পাঠান অধ্যাপক কোটেশ্বর রাজু। তিনি আমাকে নম্বর কম পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে নিজের অভিমত তুলে ধরতে বলেন। আমি তার সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলাম, তবে তিনি হঠাৎ আমাকে বসতে বলেন। সেখানে অন্য কোনও চেয়ার ছিল না, আমি কোথায় বসব, এটা বলায় তিনি তার চেয়ারেই তার পাশে আমাকে বসতে বলেন। এর অর্থ ছিল প্রায় তার কোলে গিয়ে বসা। আমি এতে মানা করি এবং তিনি ধীরে ধীরে আমার শরীরে স্পর্শ করতে শুরু করেন। প্রথমে হাতে, এরপর উরুতে তার আঙ্গুল ঘোরাফেরা করতে থাকে। ধীরে ধীরে তিনি আঙ্গুল দিয়ে আমার শরীরের অন্যান্য অঙ্গ স্পর্শ করেন। অস্বস্তি এবং ভয়ে আমি প্রতিবাদ করতে পারিনি। তাকে বলেছি, বিষয়টি আমার সহজ লাগছে না, তবে তিনি আমাকে স্বাভাবিক হতে বলেন। নম্বর কম পাওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি বলেন, নম্বর পেতে হলে কিছু তো দিতেই হয়। ওই পরিস্থিতিতেও তিনি যে প্রশ্ন করেছিলেন আমি উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম। তবে একসময় তিনি চেয়ার থেকে উঠে আমাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরেন। আমার সঙ্গে এক সহপাঠী এসেছিল, সে ওই কার্যালয়ের বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে সে ওই সময় আমার মোবাইলে ফোন করে এবং এতেই থমকে যান অধ্যাপক। আমি তার অনুমতি নিয়ে সেখান থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসি। এই ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছি এবং বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।’
তার সহপাঠীরা দাবি জানিয়েছে কোটেশ্বর রাজুকে শুধুমাত্র সাময়িকভাবে বরখাস্ত নয়, তাকে এই প্রতিষ্ঠান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হোক। তারা বলে, ‘কোটেশ্বর রাজু চার বছর আগে একই ধরনের একটি ঘটনা করেছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। যে ছাত্রীটি অভিযোগ করে, সে অনেকদিন মামলা চালিয়ে নিয়ে যায়। তবে এক সময় বেঙ্গালুরুতে তার চাকরি হয় এবং সে হাইকোর্টের কয়েকটি তারিখে উপস্থিত হতে পারিনি। এতে একতরফা রায়ে অধ্যাপককে মুক্তি দেয় আদালত। একজন পড়ুয়ার জন্য প্রথমে এত বড় পদক্ষেপ নেওয়া এবং পরবর্তীতে হাইকোর্টে মামলা চালিয়ে নেওয়া কঠিন ব্যাপার। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল ছাত্রীকে সহায়তা করা। তারা যদি আইনি সহায়তা করতে না পারেন, অন্তত এমন একজন ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠান থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেন।’ এই প্রসঙ্গে দিলীপ কুমার বৈদ্য বলেন, ‘আমরা তাকে বরখাস্ত করেছি এবং তার বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। এর বেশি ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই। তবে তদন্তের রিপোর্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে। তারা চাইলে আরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেন।’কোটেশ্বর রাজু ধেনুকন্ডাকে আটক করতে এদিন পুলিশের বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। এক আধিকরিক জানিয়েছেন, অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দ কোটেশ্বর রাজু এই ঘটনার পর নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল অথচ ঘরের বাইরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক তাকে শেষমেষ খুঁজে বের করা সম্ভব হয়। ক্যাম্পাস থেকে পুলিশের গাড়িতে তাকে নিয়ে আসা হয় সদর থানায় এবং ভারতীয় ন্যায় সংহিতার বিভিন্ন ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্ত এবং জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে আদালতে পেশ করা হবে।

নম্বর কম পাওয়া এবং অন্যান্য বাহানায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের হাতে ছাত্রীদের হেনস্তার ঘটনা আরও শোনা গেছে এবং এনিয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্ত হলেও শেষমেষ খুব একটা বিচার পায় না অভিযুক্ত, এমনটাই মনে করেন সমাজের সাধারণ মানুষ। এই ঘটনা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই নিজেদের অভিমত তুলে ধরেছেন। প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে বেরিয়ে আসা ছাত্রছাত্রীরাও জানিয়েছে তারা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। তবে পুলিশের মতে, কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আইন কিছুটা আলাদা। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সরাসরি থানায় মামলা না হলে পুলিশের খুব একটা কিছু করার থাকে না।