অনলাইন ডেস্ক : ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় কাজের জন্য বিদেশে এফডিআই সংগ্রহ করে বিপাকে পড়লেন শিলচরের বাসিন্দা প্রবাসী অস্ট্রেলিয়ান অম্বরজিৎ এন্দো ওরফে রনি। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের বন্ড কিনতে সেদেশ থেকে তিনি তাঁর সংস্থার নামে প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন বলে অভিযোগ। সিডনির প্রথম সারির প্রায় ৫০ জন বিনিয়োগকারীকে ছয় মাসে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ রিটার্ন দেওয়ার গ্যারান্টি দিয়ে এই অর্থ আদায় করেন তিনি। এই বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে গত ডিসেম্বরে তিনি আচমকা সিডনি থেকে পালিয়ে যান। অস্ট্রেলিয়া সহ ভারতের সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি কয়েকদিন থেকে চাউর হচ্ছিল। এ নিয়ে শিলচরেও চাপা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে, অম্বরজিৎ সিডনি থেকে পালিয়ে ভারতে এসে প্রথমে শিলচরে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে পরে গুয়াহাটির খ্রিস্টানবস্তির বাড়িতে বা শিলঙের কোথাও আত্মগোপন করে রয়েছেন। ভারত সরকারের এই প্রকল্পে অসম সহ উত্তরপূর্বে রাস্তা নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে এফডিআই বা ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট সংগ্রহ করেছিলেন অম্বরজিৎ। এক্ষেত্রে তিনি নিজের মালিকাধীন সংস্থা ‘এন্দো ফ্যামিলি ক্যাপ প্রপার্টি লিমিটেড’-কে কাজে লাগান। কিন্তু অর্থ সংগ্রহ করে প্রকল্পের পুরো মেয়াদের আগেই রহস্যজনক কারণে তিনি উধাও হয়ে যান। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর অস্ট্রেলিয়ার বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়। ইতিমধ্যে বিনিয়োগকারীরা সিডনির নিউ সাউথ ওয়েলস এবং ভিক্টোরিয়া পুলিশের কাছে প্রতারণার মামলা দায়ের করেছেন। দুই রাজ্যের পুলিশ তদন্তে নেমেছে। এই প্রতারণার ঘটনাটি প্রকাশ্যে নিয়ে আসেঅস্ট্রেলিয়ার প্রথম সারির সংবাদপত্র ‘দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ এবং ‘দ্য এজ’। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ইনফোসিসে একজন বিশ্লেষক হিসেবে সিডনিতে কর্মজীবন শুরু করেন শিলচরের অম্বরজিৎ ওরফে রনি। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বহুজাতিক সংস্থা ‘ডেলয়েট’-এর অংশীদার হয়ে সিনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে দীর্ঘ ১৩ বছর কাজ করার সুবাদে এবং সেই সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুবাদে দেশের সেরা বিনিয়োগকারীদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। ‘ডেলয়েট’-এ থাকাকালীন অম্বরজিৎ নিজের পারিবারিক ব্যবসার ফাঁদ ফেলেন। তখনই গড়ে তুলেন নিজস্ব মালিকানাধীন সংস্থা ‘এন্দো ফ্যামিলি ক্যাপ ট্রাস্ট’। ২০২১ সালে ‘ডেলয়েট’ ছেড়ে তিনি অন্য সংস্থা সায়ার্স গ্রুপে যোগ দেন। কিন্তু সেখান থেকে ছয়মাস পরই তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভারত সরকারের কথিত বন্ড কেনার জন্য বিনিয়োগ প্রকল্প বা চিটফান্ড চালু করেন। এতে তাঁর পুরনো দুটি সংস্থার নামীদামী এবং বিশ্বাসী কয়েকজন বিনিয়োগকারীকেও পাশে পেয়ে যান। তাঁরাও অম্বরজিতের সংস্থায় অর্থ লগ্নি করেন। অম্বরজিত সম্পূর্ণ ঝুঁকিহীন এবং বিপুল আয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করেছিলেন। ২০২২ সালের ১ জুলাই নিজের স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রোফাইলে তিনি উল্লেখ করেন, ভারতে তাঁর পারিবারিক ব্যবসা অত্যন্ত ভালভাবে চলছে। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় অসম সহ উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলিতে তাঁর পারিবারিক কোম্পানি বেশ সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। এই প্রকল্প রূপায়নে দেশের প্রথম তিন ঠিকাদার সংস্থার মধ্যে তাদের পরিবারও একটি। এই কোম্পানি শুধু সংশ্লিষ্ট প্রকল্প রূপায়নের জন্যই অস্ট্রেলিয়ায় এফডিআই সংগ্রহ করতে চাইছে। যে প্রকল্প সরাসরি ভারত সরকার পরিচালিত। ফলে এই প্রকল্পে লগ্নিতে যে কোনও ঝুঁকি নেই সেটা দাবি করেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে তিনি জানান, গোটা প্রকল্পের মাত্র ১০ শতাংশ টাকা এফডিআই মারফৎ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই লগ্নিতে মোটা অঙ্কের টাকা রিটার্ন দেওয়ারও গ্যারান্টি দেওয়া হয়। কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বাধিক ৪০ শতাংশ লাভের সংস্থান রয়েছে বলে তিনি ঘোষণা করেছিলেন।
এই কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সিডনি পুলিশ তদন্তে নামে। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের একটি দল বুটিক অ্যান্টি-ফ্রড পেশাদার পরিষেবা সংস্থা ডাক্সটন হিলকে খোয়া যাওয়া অর্থ খুঁজে বের করতে নিয়োগ করে। সংবাদ মাধ্যমকে ডাস্কটন হিল-এর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে সেদেশের চারটি ব্যাঙ্ক থেকে অম্বরজিৎ সব টাকা ট্রান্সফার করে নিয়েছেন। এমনকি গোটা অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এই ইস্যুতে অস্ট্রেলিয়া সরকার ভারত সরকারের কাছে ইতিমধ্যে সাহায্য চেয়েছে বলেও জানা গেছে। বর্তমানে অস্ট্রেলীয় ফেডারেল পুলিশ, ভিক্টোরিয়া পুলিশ এবং ভারতের উপযুক্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অম্বরজিতের সন্ধান চালাচ্ছে।
বস্তুত, অম্বরজিতের প্রতারণা শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ভারতেও সেই জাল বিস্তার করেন তিনি। নয়াদিল্লির বাসিন্দা মেহেরজিৎ শাহ নামে একজন গৃহবধূ সামাজিক মাধ্যমে কয়েকদিন থেকে অম্বরজিতের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার চালাচ্ছেন। বিভিন্ন পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘অম্বরজিৎ এন্দো নামে শিলচরের এক ব্যক্তি সম্পর্কে আমি সবার সঙ্গে একটি বিরক্তিকর গল্প শেয়ার করে চাই। তাঁর ডাক নাম রনি। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় একটি ভুয়ো প্রকল্প চালিয়ে মানুষের কাছ থেকে ৬০ মিলিয়ন ডলার চুরি করেছেন। আমিও ভুক্তভোগীদের একজন…… অম্বরজিৎ প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় বিনিয়োগ করতে প্ররোচিত করেছিলেন। এখনও এই কেলেঙ্কারি চলছে। তাই আমি অম্বরজিৎ ও তাঁর স্ত্রী মিনহি সম্পর্কে আপনাদের সতর্ক করতে চাই। তাদের বিশ্বাস করে কেউ অর্থ বিনিয়োগ করবেন না। তাদের ধরতে আমাকে সাহায্য করুন। ছবি দেখে যদি কেউ চিনতে পারেন, বা কোথাও দেখতে পান, তাহলে একটি বার্তা দিন।’
এদিকে, গোটা ঘটনাক্রম নিয়ে অবশেষে মুখ খুলেছেন এই কান্ডের প্রধান হোতা অম্বরজিৎ এন্দো। এদিন তিনি সিডনির সংবাদ মাধ্যমে একটি ইমেল বার্তায় জানিয়েছেন, তাঁর বিনিয়োগ প্রকল্পে অন্যায়ের কিছু ছিল না। তিনি বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ করার অভিপ্রায় নিয়েও কোম্পানি পরিচালনা বা এফডিআই সংগ্রহ করেননি। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা মাঝপথে নিজেদের টাকা উঠিয়ে নিতে চাপ সৃষ্টি করায় সমস্যা দেখা দেয়। অম্বরজিৎ লিখেছেন, তিনি এই প্রকল্প থেকে ‘ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক লাভবান’ হননি। কারণ তিনি ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ রিটার্নের গ্যারান্টি দিয়েছিলেন।এই বিনিয়োগ তহবিলের জন্য তিনি এবং তাঁর পরিবার বিভিন্নভাবে হুমকির সম্মুখীন হন। এই বার্তায় অম্বরজিৎ আরও বলেছেন, বিনিয়োগকারীরা যে ৬০ মিলিয়ন ডলার লগ্নির কথা এখন প্রচার করছেন, সেটা আদৌ সত্যি নয়। কিন্তু এই প্রকল্পে কত টাকা লগ্নি হয়েছে, বা তিনি কেন পুরো টাকা নিয়ে সিডনি ছেড়ে ভারতে পালিয়ে এসেছেন, বা বিনিয়োগকারীরা তাদের টাকা ফেরত পাবে কি না, সে ব্যাপারে এই ইমেলে কিছুই উল্লেখ করেননি অম্বরজিৎ। তিনি নিজের প্রকল্পে অর্থ লগ্নির জন্য অন্যান্য ডেলয়েট অংশীদারদের নাম ব্যবহারের কথাও অস্বীকার করেছেন। অম্বরজিৎ জানান, তাঁর পুরো প্রকল্প বড় চারটি পরামর্শদাতা সংস্থা থেকে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু এফডিআই সংগ্রহের পর স্বাভাবিক কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয় বিভিন্ন কারণে।২০২২ সালের শেষের দিকে একাংশ বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে হুমকি আসা শুরু হয়, যা এখনও অব্যাহত। নিয়মিত ফোন কল, মেসেজ এবং ইমেলের মাধ্যমে হুমকি আসতে থাকে। যার ফলে বাধ্য হয়ে অম্বরজিৎ সামাজিক ও ডিজিটাল মাধ্যমে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন।
অন্যদিকে, এই কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পর শিলচরের অনেকেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা জানান, অম্বরজিৎ বা রনি অস্ট্রেলিয়ায় ডেলয়েটের মতো প্রথমসারির বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করার সুবাদে যখনই শিলচর আসতেন, একদিনের বেশি থাকতেন না। এমনকি নাজিরপট্টির বাড়িতে তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা গিয়েও দেখা পেতেন না। কিন্তু গত ডিসেম্বরে দেখা যায়, রনি যেন শিলচরে আসার পর আর ফিরে যেতে চাইছিলেন না। বেশ কিছুদিন তাঁকে দিব্যি ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। তখনই তাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। বর্তমানে বিপদ বুঝে তিনি গুয়াহাটি খ্রিস্টানবস্তির বাড়িতে বা শিলঙের কোথাও আত্মগোপন করে থাকতে পারেন বলেও তাঁরা সন্দেহ করছেন।