সম্পাদকীয়
হালফিলে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলির মধ্যে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিয়ে এখন দারুণ চর্চা চলছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। শুধু সোশ্যাল মিডিয়া বললে ভুল হবে, মেইন স্ট্রিম মিডিয়া বা চিরাচরিত প্রচার মাধ্যমের বেশ জায়গা দখল নিয়েছে কেরালা স্টোরি। আর রাজনীতির কথা উল্লেখ করলে বলতে হয়, এখন নেতারা কিংবা কিছু দল বিশাল সিনেমা–বোদ্ধা ! বিষয়টি একেবারেই নতুন নয়। এর আগেও সিনেমা–সাহিত্য কিংবা যে কোনও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক খবরদারি ঘটেছে। পুরনো কাসুন্দি না ঘেঁটেও এবার ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ ও সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কেরালা স্টোরি নিয়ে যে টানাপোড়েন, তা সত্যিকার অর্থে সিনেমা বোদ্ধা বা নিছক সিনেমাপ্রেমী তাঁদের বিব্রত করে তুলছে। বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর পর ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিয়ে বিনোদনের পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলেও শোরগোল পড়ে গিয়েছে।
একাধিক রাজনৈতিক দল এই ছবির বিরোধিতা করছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শো বাতিল হয়েছে। এই বাতিল–বাতিল পদক্ষেপ বা রাজনৈতিক কোপে পড়েও ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ কার্যত উপার্জনের নিরিখে রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছে। প্রথম দিনেই দুর্দান্ত আয় দিয়ে শুরু হয়েছে ছবির যাত্রা।এই বছরে সব থেকে বড় ওপেনিং ছবির তালিকায় ৫ নম্বরে উঠে এসেছে আদা শর্মা অভিনীত ছবিটি।
মুক্তির প্রথম দিনে ৮ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে যে ছবি তা আগামী দিনগুলোতে ব্যবসা আরও বাড়াবে তা বলাই বাহুল্য। কারণ, নিষেধের ফরমান ও নেতাদের সস্তা প্রচারের আপাতবিরোধী অবস্থানে সেই ব্যবসারই লাভ হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হল কেন কেরালার এই গল্প নিয়ে এত সমালোচনা? ভুল হলো, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ? দর্শকদের একাংশ কেনই বা এত বিতর্ক সত্ত্বেও ছবিটিকে পছন্দ করছেন? তার জন্য জানতে হবে ছবির বিষয়বস্তু।এই ছবিটি আসলে হিন্দু তরুণীদের ফাঁদে ফেলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা এবং তাদের জঙ্গি দলে যোগ দেওয়ানোর প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছে।
ছবির মুখ্য শালিনী থেকে ফাতিমা হতে হয়েছেন। তারজীবন সংগ্রামকে কেন্দ্র করেই গল্প আবর্তিত হয়েছে। মূলত ধর্মান্তরিতকরণ এবং সন্ত্রাসী–যোগ নিয়ে ছবিটি। কোনও অভিসন্ধিতে এই ছবিটি নির্মিত, সেটা বিচার করবে কে? সেন্সর বোর্ড এসব এসব দেখার জন্য থাকতেও কেন রাজনীতি করিয়েরা ব্যান অথবা সশরীরে হলে বসে দেখার জন্য উদগ্রীব? নেতারা হঠাত করে সিনেমাপ্রেমী বা সিনেমার বিরোধিতায় মেতে উঠলেন, এ নিয়ে বরং সাধারণ দর্শক ইদানিং খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না। কারণ, দলীয় হস্তক্ষেপ ও নেতাদের নাক গলানোর কারণ আজকাল সবাই কমবেশি বোঝেন। তাঁদের অনেকেই এইসব ব্যান ও সিনেমা দেখার বা প্রচারের পেছনে রহস্য নিয়ে মাথা ঘামানো থেকে উপেক্ষা না করে এক ফাঁকে দেখে নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া না করার পক্ষে। আর সিনেমা হল বা থিয়েটারে না গিয়ে হাতের চেটোতে রেখে বালিশে মাথা দিয়ে ছবির দর্শক হয়ে যান।
আসলে তারা নেতাদের প্রচার বা ব্যানে খুব একটা আমল দেন না। গড়পড়তা বা ছাপোষা দর্শকদের বেশিরভাগই সিনেমা দেখেন নিছক বিনোদনের জন্য। ভারি কথার বোঝা মাথায় নিতে তারা সিনেমা দেখেন না। তেমনি যে কোনও সৃজনশীল সাহিত্য ও শিল্পকলা নিয়ে বৌদ্ধিক লড়াই থেকে লক্ষ যোজন দূরে তাঁদের বাস।এবার নিষিদ্ধ এবং পক্ষে প্রচার কে করল, এতে তাঁদের যায় আসেনা। কিন্তু কোনও না কোনও ভাবে তাঁরা টার্গেট ভোটার। তাঁদের প্রভাবিত করলে কেল্লা ফতে ভেবে নেতারা এখন শিল্পকলারও নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছেন। সেটা বিপজ্জনক। প্রথমত, নেতাদের প্রচারে যেমন খুব একটা প্রভাব পড়েনা,তেমনি নিষিদ্ধ করার ফরমানেও কিস্যু যায় আসেনা। মনে রাখা দরকার, নিষিদ্ধ কিছুর প্রতি মানুষের আগ্রহ যেমন অনস্বীকার্য, রাজনৈতিক প্রচারেও ফায়দা। উভয়ই সেই ছবি বা শিল্পের ক্রেতা ও ভোক্তার সংখ্যাবৃদ্ধির কাজ গোপনে ও প্রকাশ্যে করে যাচ্ছেন, দর্শকরা তা ঠিক বুঝতে পারেন। তাই, সিনেমা কিংবা যে কোনও শিল্পে রাজনৈতিক নাক গোলানো কাম্য নয়। নিষিদ্ধ করে বা দরজা বন্ধ করে ভ্রম রোখার পথ বন্ধ হলে সত্যটাই কানাগলিতে হারিয়ে যাবে। তার বিপরীতে উটকো প্রচারেও সত্যকে আড়াল করা অসম্ভব।