অনলাইন ডেস্ক : সই জাল করে ভূয়ো নথি বানিয়ে জমি হড়প করার মামলায় জড়িয়েছিলেন জেলা ভূবাসন কার্যালয়ের পাটোয়ারি পরিমল সিনহা। এবার সেই অভিযোগে সিলমোহর দিল ফরেনসিক বিভাগ-ও। রাজ্যের ডিরেক্টরেট অব ফরেনসিক সায়েন্স-এর সায়েন্টিফিক অফিসার বাপুকান চৌধুরী স্বাক্ষরিত রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, শিলচর সদর থানায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০/৪৬৮/৪৭১/৩৪ ধারায় নথিভুক্ত ২৫১৯/২০২২ নম্বরের মামলার সূত্র ধরে যে-সব নথির (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) স্বাক্ষর যাচাই ও হাতের লেখা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল, তা প্রকৃত জমি মালিকদের নয় !
সম্প্রতি এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর পশ্চিম শিলচর এলাকায় দেখা দিয়েছে চাঞ্চল্য। সাধারণ মানুষের কাছে এটাও জলের মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, যে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’র ভিত্তিতে মলয় সিনহাকে জমি বিক্রি করেছিলেন পাটোয়ারি পরিমল সিনহা, তা জালিয়াতির-ই নামান্তর মাত্র। এদিকে, জাল নথির বলে বলীয়ান মলয় সিনহা উল্টে প্রকৃত জমি মালিকদের ভূ-মাফিয়া সাজানোর চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন। অপপ্রচার চালাচ্ছেন সংবাদ মাধ্যমে। আর জমি হড়প এবং অপপ্রচার চালানোর এই খেলায় তাকে আড়াল থেকে মদত যুগিয়ে যাচ্ছেন পরিমল ও তার সঙ্গীরা।
বুধবার শিলচরে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে পাটোয়ারি পরিমল সিনহা ও তার সঙ্গী মলয় সিনহাদের বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগ এনেছেন জমি মালিক জিতেন্দ্র সিংহ। তিনি দাবি করেন, কস্মিনকালেও তিনি পরিমল সিনহা বা মলয় সিনহাকে কোনও জমি বিক্রি করেননি। বরং তাঁকে সহ পশ্চিম শিলচরের কয়েকজন জমি মালিককে অন্ধকারে রেখে ভূয়ো ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ তৈরি করে জমিয়ে হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত করেছিলেন জেলা ভূবাসন কার্যালয়ের পাটোয়ারি পরিমল সিনহা। তারপর তিনি সেই জমি তার দোসর মলয় সিনহাকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর ভূবাসন কর্মী পরিমল সিনহা ও তার পত্নী বিজুলি সিনহা, মলয় সিনহা সহ দলিল লেখক ফয়জুল হক লস্কর এবং অতুল কুমার নাথদের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ২ নভেম্বর শিলচর সদর থানায় মামলা করেন সিঙ্গারির লক্ষীরাজ সিনহা। মামলাটি ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০/৪৬৮/৪৭১/৩৪ ধারায় নথিভুক্ত করে পুলিশ। এজাহারে লক্ষ্মীরাজ সিনহা উল্লেখ করেন, অম্বিকাপুর সপ্তম খণ্ডে প্রায় ৩০ কাঠা কৃষিজমি রয়েছে তাদের। বংশানুক্রমিকভাবে সেই জমিতে চাষবাস করে আসছেন তারা। কোনও দিন সমস্যা হয়নি। কিন্তু হঠাৎ ২০২২-র অক্টোবর মাসে তাদের সেই পৈতৃক সম্পত্তির ১ বিঘা ১০ কাঠা জমিতে দখল নিতে আসেন মলয় সিনহা। মাপজোখ করে সীমানা পিলারও পুঁতে রাখা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করলে শিলচর ন্যাশনাল হাইওয়ে রোডের বাসিন্দা মলয় সিনহা দাবি করেন, তাকে ওই জমি বিক্রি করেছেন ভূবাসন কার্যালয়ের কর্মী পরিমল সিনহা।
সঙ্গে সঙ্গে লক্ষীরাজ সিনহারা জেলা ভূবাসন ও সাব রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে খোঁজখবর নেন। সেখানে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা প্রায় সবারই। দেখা যায়, ২০১৮ সালের ১১মে লক্ষীরাজ সিনহার ‘সই জাল’ করে মোক্তারনামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) সম্পাদিত হয়েছে পরিমল সিনহার নামে। এর ঠিক চারদিনের মাথায় ২০১৮ সালের ১৫ মে তারিখে মোক্তারনামাটি শিলচরের সিনিওর সাব রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে নথিভুক্ত হয়। সেই মোক্তারনামা অনুযায়ী লক্ষীরাজদের অম্বিকাপুর সপ্তম খণ্ডে থাকা পৈতৃক সম্পত্তির ১ বিঘা ১০ কাঠা জমির মালিকানা হস্তান্তর থেকে শুরু করে যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার বর্তায় পরিমল সিনহার উপর। এই ঘটনার ছ’মাস পর ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর তারিখে সম্পাদিত দলিলে উল্লেখিত জমি মলয় সিনহাকে বিক্রি করে দেন পরিমল সিনহা। সাব রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে সেই দলিল নথিভুক্ত হয় ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর।
এজাহারে লক্ষীরাজ দাবি করেন, এই জমি বিক্রির ব্যাপারে তিনি বিন্দুবিসর্গ জানতেন না। পরিমল সিনহা কেন, তিনি কাউকে-ই জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেননি। পরিমলের কাছে যে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি রয়েছে সেটাতে তার সই জাল করা হয়েছে। কোনও অছিলায় তার ভোটার পরিচয় পত্রের ফটোকপি হাতিয়ে অন্য কোনও লোককে লক্ষীরাজ সাজিয়ে কাজ হাঁসিল করেছেন পরিমল। পরে সেই জমি বিক্রি করেছেন মলয় সিনহাকে। লক্ষীরাজের আরও অভিযোগ, আসলে মলয় সিনহাদের নিয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে সিন্ডিকেট চালাচ্ছেন পরিমল সিনহা। ভুয়ো নথির সাহায্যে প্রথমে নিজের নামে এবং পরে সেই জমির মালিকানা মলয় সিনহাকে হস্তান্তর করেছেন। এই কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন তার পত্নী বিজুলি সিনহা। যিনি দলিল সম্পাদনে অন্যতম সাক্ষী হিসেবে সই করেছেন।
থানায় মামলা দায়ের করে লক্ষীরাজ আবেদন জানান, পরিমলের দলিলে থাকা তার সই আসল কি-না, তা বিশেষজ্ঞ দিয়ে যাচাই করা হোক। সেই সঙ্গে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিক পুলিশ। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নথি যাচাইয়ের জন্য ফরেনসিক বিভাগে পাঠায় পুলিশ। এরপরই সই জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে আসে।
উল্লেখ্য, বাইপাস চালু হওয়ার পর পশ্চিম শিলচরে জমির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। কয়েক বছর আগে যে জমি বিক্রি হয়েছে জলের দরে, বাইপাস হবার পর সেটাই বিকোচ্ছে চড়া দামে। ফলে জমি হাঙ্গরদের শ্যেনদৃষ্টি পড়েছে ওই অঞ্চলে। প্রকৃত জমি মালিকদের অন্ধকারে রেখে রাতারাতি ভূয়ো নথিপত্র বানিয়ে শুরু হয়েছে মূল্যবান জমি হাতিয়ে নেওয়ার খেলা ! এই খেলায় জেলা ভূ-বাসন কার্যালয়ের একাংশ অসাধু কর্মী-আধিকারিকদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে সিন্ডিকেট। অভিযোগ, সেই সিন্ডিকেটের মধ্যমনি হচ্ছেন পরিমল সিনহা।
অবশ্য এ-ই প্রথম নয়, এর আগেও পরিমলের বহু বিতর্কিত কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে এসেছে। ২০২৩ সালে কালিঞ্জর এলাকার বাসিন্দা ব্রজ কুমার সিনহা নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, তার বৃদ্ধা মা রাধারানি সিনহা ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায়ই জমি হড়পের জন্য ওই পাটোয়ারি সাদা কাগজে টিপ সই নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন। ব্রজকুমার জানান, তার মা সিঙ্গারি এলাকায় নিজের বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। মায়ের বোন অর্থাৎ তার মাসির আত্মীয় ওই পাটোয়ারি। বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে একদিন দুপুরে মা ঘুমোচ্ছিলেন। সেই সময় পাটোয়ারী সেখানে গিয়ে ঘুমন্ত মায়ের আঙ্গুলে কালি লাগিয়ে একটি সাদা কাগজে টিপসই নেওয়ার চেষ্টা চালান। যদিও মাসি ব্যাপারটা দেখে ফেলায় সে যাত্রা তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
বিগত দিনে বহু গুরুতর অভিযোগ উঠলেও পরিমল সিনহা নামের ওই পাটোয়ারি ও তার সঙ্গী মলয় সিনহার বিরুদ্ধে রহস্যজনক কারণে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি প্রশাসন। সম্প্রতি এদের বিরুদ্ধে অম্বিকাপুর দ্বিতীয় খণ্ডে দুবড়ি বিল সংরক্ষণ কমিটির তত্বাবধানে থাকা বাইপাস সংলগ্ন দ্বিতীয় রিজরিপের ১২১ নং পাট্টার ৬৯ বিঘা ৩ কাঠা এবং অম্বিকাপুর তৃতীয় খণ্ডের দ্বিতীয় রিজরিপের ১ নং ও ২৫ নং পাট্টার ১০৯ বিঘা জমি হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত চালানোর অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। এলাকায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, পশ্চিম শিলচরের এক শাসকদলীয় রাজনৈতিক নেতার হাত রয়েছে এ দু’জনের মাথার ওপর। ফলে পুলিশ প্রশাসন চাইলেও উপযুক্ত পদক্ষেপ করতে পারছে না। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সুবিচারের আবেদন জানিয়েছেন জিতেন্দ্র সিনহা।