অনলাইন ডেস্ক : সকাল থেকেই বৃষ্টি। কখনও থেমে থেমে, কখনও অঝোর ধারায়। কিন্তু কোনও প্রতিকূলতা-ই যেন অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারেনি এদিন। নিটফল, মেঘ-বৃষ্টির লুকোচুরির মধ্যেও শুক্রবার আক্ষরিক অর্থেই উনিশময় হয়ে ওঠে শিলচর পার্ক রোডের মেঘলা দুপুর।ঝিরঝির বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে গান্ধী বাগে ঢল নামে উনিশের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ মানুষের। নাচ, গান, আবৃত্তি, গ্রন্থ প্রকাশ, অঙ্কন, শহিদ স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা তর্পণ এবং এর পাশাপাশি কলকাতা, ত্রিপুরা সহ এপার ওপার দুই বাংলার শিল্পী সংস্কৃতি প্রেমী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান বুঝিয়ে দেয় যে, এগারোটি তাজা প্রাণের বুকের রক্তে সিঞ্চিত ভূমিতে যে বীজ বপন হয়েছিল একদিন, ৬২ বছরের শেকড় বিস্তারে সে আজ শাখাপ্রশাখা পল্লবিত মহীরুহ। উনিশের চেতনা আজ কোনও ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ নয়। সে ক্রম প্রসারমান।
শুক্রবারের দুপুর। ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে বারোটার ঘর ছুঁইছুঁই। বৃষ্টি তখনও পড়ছে। কখনও হালকা, কখনও মাঝারি। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গান্ধীবাগে জমায়েত হতে থাকেন বিভিন্ন দল সংগঠনের কর্মকর্তা সহ উনিশের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ মানুষজন। একাদশ শহিদকে শ্রদ্ধা জানাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি সহ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রেমীরা তাঁদের ব্যানার সহযোগে মিছিল করে এসে জমায়েত হতে থাকেন গান্ধীবাগের মূল ফটকের সামনে। দুপুর একটার পর থেকে বহর বাড়তে থাকে জমায়েতের।
পার্কের ভেতর গোলাকৃতি ঘরসদৃশ ছাউনিকে মুক্ত মঞ্চ বানিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করে বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন। সেখানে দিলীপ কান্তি লস্কর সম্পাদিত কবিতার সংকলন ‘উনিশের কবিতা ও গান’ সহ উন্মোচিত হয় শান্তনু গঙ্গারিডি সম্পাদিত ‘উনিশের গল্প সংকলন’। বই দুটির আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন পর্বে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য, বরাকবঙ্গ-র জেলা সভাপতি সঞ্জীব দেব লস্কর, কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত , পরিতোষ চন্দ্র দত্ত, অধ্যাপক বিশ্বতোষ চৌধুরী ও আশিস চৌধুরী। কথা গান আবৃত্তিতে অংশ নেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য সংস্কৃতিকর্মী গোলাম কুদ্দুস, কলকাতার পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়, বাচিক শিল্পী সেলিম দুরানি প্রমুখ। মুক্ত মঞ্চে গান গেয়ে শোনান পশ্চিম বঙ্গের জনপ্রিয় কণ্ঠ শিল্পী শুভেন্দু মাইতি, শিলচরের বিশিষ্ট সংস্কৃতি কর্মী বর্তমানে কলকাতা প্রবাসী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার সহ অন্যান্যরা। আবৃত্তি করেন কলকাতার বিজয়া পাল, ত্রিপুরার জবা পাল, ঝরনা সাহা প্রমুখ। এর আগে বিজয় কুমার ভট্টাচার্যের কবিতা পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় দিনের কার্যসূচি। গান্ধীবাগের মুক্ত প্রাঙ্গণে উনিশকে কেন্দ্র করে ক্যানভাসে ছবি আঁকেন বরাক আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট সোসাইটি এবং গ্রুপ অব কালারস-এর শিল্পীরা। বরাকবঙ্গের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যকর্মী গোলাম কুদ্দুস বলেন, ভাষার অধিকার সর্বোপরি মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার সংগ্রামের জন্য উনিশ এবং একুশ আজ একাকার। যদিও দুটি দেশের সংগ্রামের প্রেক্ষিত আলাদা, কিন্তু লড়াইয়ের পটভূমি প্রায় এক। তাঁর কথায়, ভাষার কোনও রাষ্ট্র নেই, সীমা নেই। চিরন্তন এ লড়াই কোনও দিন থেমে থাকে না। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, ভাষা সংগ্রামের সোপান বেয়ে-ই একদিন স্বাধীনতার সিংহদুয়ারে পৌছে ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু বুকের রক্তে অর্জিত অধিকার সুরক্ষিত রাখতে এখনও লড়াই চলছে বাংলাদেশে। ব্যতিক্রম নয় এপারও (বরাক ভূখণ্ডে)। তাই ওপার বাংলায়ও আগলে রাখতে চায় উনিশকে।
তিনি বলেন, আবহাওয়া প্রতিকূল থাকা সত্ত্বেও এদিন শিলচরবাসীর মধ্যে যে আবেগ দেখেছেন, বিশেষ করে যুব-প্রজন্মের মধ্যে, তাতে তিনি অভিভূত। অপর বক্তা পার্থ সারথি মুখোপাধ্যায় বলেন, ভাষার মর্যাদা এবং অধিকার রক্ষায় দলমত, জাতি ধর্মের উর্ধ্বে উঠতে হবে। শহিদ স্মৃতি সৌধে দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে শুরু হয় শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা। অবশ্য এর আগেই থেমে যায় বৃষ্টি। শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসে শিলচরের বিধায়ক দীপায়ন চক্রবর্তী বলেন, প্রতিদিনের যাপনে উনিশ হোক এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারণ, একাদশ শহিদের আত্মত্যাগ শুধু বাংলা কিংবা বাঙালির জন্য নয়। সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার প্রতীক হচ্ছে উনিশ। তাই আজ বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ সামিল হয়েছেন শহিদ তর্পণে।
রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ সুস্মিতা দেব বলেন, মাতৃভাষা-ই সবার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। যে কারণে, ভাষাই আমাদের পরিচয়। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, রাজ্যে বর্তমানে বাংলা ভাষার ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে। বড়ো, মিসিং সহ অন্যান্য ভাষাকে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। এ-সব কথা উল্লেখ করে সুস্মিতা এ-ও বলেন, বাংলা ভাষার ওপর যাতে আঘাত না আসে, সে দিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে সরকারের।
এদিন কাছাড়ের জেলাশাসক রোহনকুমার ঝা, ডিডিসি রাজীব রায়, ডিএসএ সভাপতি বাবুল হোড়, বিশিষ্ট আইনজীবী অনিল দেব, বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে অর্কিড পেন্টার্স গ্রুপ, লায়ন্স ক্লাব, নেতাজি ছাত্র যুব সংস্থা, ক্লাব আমরা, শিলচর প্রেস ক্লাব, বরাক নাগরিক সাংসদ, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, ইউটিডিসি , রোটারি ক্লাব অব গ্রেটার শিলচর, উনিশে মে উদযাপন কমিটি, জেলা বার সংস্থা, উত্তমাশা কলাকেন্দ্র, ক্লাব অনন্যার পক্ষে মধুমিতা পাল, সোনালি বণিক, শিপ্রা পুরকায়স্থ, শম্পা ধর ঝুমা পুরকায়স্থ ভারত বাংলাদেশ মৈত্রি সংসদ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সংস্কৃতি সমিতি, আকসা, হিউম্যানস অব শিলচর, আমরা বাঙালি, সিআরপিসি, রূপম সহ অন্যান্য সংগঠনের সদস্যরা শহিদ তর্পন করেন।