পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ ভারত। প্রয়োজনের ৮৫ শতাংশ অপরিশোধিত খনিজ তেল কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করে। এর মধ্যে বিপুল পরিমাণ কেনে রাশিয়া থেকে। তেল সংক্রান্ত বাণিজ্যের প্রশ্নে ভারত-রাশিয়া স্বাভাবিক মিত্র। রাশিয়ান তেলের দ্বিতীয় বৃহৎ ক্রেতার নাম ভারত, চিনের পরেই গুরুত্ব ভারতের। আরও লক্ষণীয় যে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলি যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, ভারত সচেতনভাবেই নিজেকে সেই পংক্তিতে বসায়নি, যুদ্ধের দ্রুত অবসান চেয়েও বজায় রেখেছে রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতার ঐতিহ্য। রাশিয়ার তেল বাণিজ্যের বিরুদ্ধেও খড়্গহস্ত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমী দেশগুলি। এমনকী রাশিয়ার তেল কিনতে ভারতকে বারণই করা হয়েছিল। রাশিয়াকে জব্দ করতে ভারতের উপর কঠিন শর্ত চাপাতে চেয়েছিল আমেরিকাসহ কয়েকটি শক্তিধর দেশ। কিন্তু ভারত তাতে দমে যায়নি, বরং বলা ভালো পাত্তাই দেয়নি। চিরাচরিত যুদ্ধ-বিরোধী নীতিকে সামনে রেখেই রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রেখেছে।
ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আগ্রাসন আছড়ে পড়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি। সেইদিক থেকে যুদ্ধের বর্ষপূর্তি আসন্ন। যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব পড়েছে সমগ্র বিশ্ব অর্থনীতির উপর। এখনও সুরাহা মেলেনি। তাই অর্থনৈতিক সঙ্কটের বিকল্প সমাধানের সন্ধানে এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ জি-সেভেন গোষ্ঠীর দেশগুলি। তারা চায় রাশিয়ার তেল সমুদ্রপথে পরিবহণ, বিমা এবং অন্যান্য আর্থিক সুবিধাসহ বাণিজ্য চালু রাখতে হলে পশ্চিমী দুনিয়ার প্রাইস ক্যাপ (দামের উপর নিয়ন্ত্রণ) মেনে চলতে হবে। ব্যারেল প্রতি ৬০ মার্কিন ডলারের বেশি রাশিয়া নিতে পারবে না। বস্তুত ওয়েস্টার্ন ব্লক ‘বায়ার্স কারটেল’ গঠন করে ফেলেছে। আমেরিকা মনে করে, এতে আর্থিকভাবে যথেষ্ট লাভবান হচ্ছে ভারত। পশ্চিমী দেশগুলির অনুমান যে মিথ্যে নয়, তার প্রমাণ যুদ্ধ পরবর্তীকালে রাশিয়া থেকে তেল কেনার পরিমাণ ভারত বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহলের হিসেব, এই পর্বে তেল কেনা হয়েছে যুদ্ধ পূর্ববর্তীকালের প্রায় দশগুণ । গত এপ্রিল-অক্টোবর সাতমাসে ভারত তেলের দাম মিটিয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলার। গত দশবছর মিলিয়েও ভারত এত টাকার তেল রাশিয়া থেকে কেনেনি। অক্টোবর ও নভেম্বরে রাশিয়ার তেল ক্রয়ের রেকর্ড গড়ে ফেলেছে ভারত। রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল ভারতে ঢুকেছে দৈনিক গড়ে ৯ লক্ষ ৯ হাজার ব্যারেল । নভেম্বরে সরকার যত তেল আমদানি করেছে তার ৪০ শতাংশই এসেছে পুতিনের মুলুক থেকে।
ভারতের এই অবস্থানকে পাশ্চাত্য দুনিয়া মোটেই ভালোভাবে নিতে না পারলেও বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থে বলে সাফাই দিচ্ছে ভারত। এদিকে রাশিয়া ফ্যাক্টরে আন্তর্জাতিক বাজারেও তেলের দাম তলানিতে—প্রতি ব্যারেল ৮১ ডলার। কিছুদিন আগেও দামটা ছিল ১১৬ ডলার। ক্রিসিলসহ একঝাঁক শিল্প ও আর্থিক সংস্থার বিশেষজ্ঞদের হিসেবে, এই পর্যায়ে শুধু তেল ক্রয় বাবদ ভারত সরকারের সাশ্রয়ের পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কোনও সন্দেহ নেই, এতে দেশই লাভবান হয়েছে ও হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল—দেশ কি মানুষকে বাদ দিয়ে? রাজকোষের সুস্বাস্থ্যের ভাগ নাগরিকের শরীরে লাগবে না কেন? মোদ্দা কথা, সরকারের ঘরে সুখের ছোঁয়া নাগরিকের ঘরেও পৌঁছে যাওয়া জরুরি। তেলের দাম অবিলম্বে কমানোই তার উপায়। ভারতে তেল এবং পেট্রোপণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজার দরের ভিত্তিতে ওঠানামা করার কথা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বমুখী দামের সময় দেশের বাজারে বিনা নোটিসে এসব অগ্নিমূল্যই হয়ে ওঠে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে সস্তা দরের বেলা তেল সংস্থাগুলি ঘাপটি মেরে থাকে এবং আবেদন নিবেদন করেও সরকারের টনক নড়ানো যায় না। সরকারের এই নীতি কোনওভাবেই জনস্বার্থবাহী বলে ধরে নেওয়া যায়না। এই অবস্থানে বদল আনা জরুরি।