স্বরাজ সাধনায় নারী
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
অনলাইন ডেস্ক : শাস্ত্রে ত্রিবিধ দুঃখের কথা আছে। পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখকেই হয়ত ঐ তিনটির পর্যায়েই ফেলা যায়, কিন্তু আমার আলোচনা আজ সে নয়। বর্তমান কালে যে তিন প্রকার ভয়ানক দুঃখের মাঝখান দিয়ে জন্মভূমি আমাদের গড়িয়ে চলেছে, সেও তিন প্রকার সত্য, কিন্তু সে হচ্ছে রাজনৈতিক, আর্থিক এবং সামাজিক। রাজনীতি আমরা সবাই বুঝিনে, কিন্তু এ কথা বোধ করি অনায়াসেই বুঝতে পারি এই তিনটিই একেবারে অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িত। একটা কথা উঠেছে, একা রাজনীতির মধ্যেই আমাদের সকল কষ্টের, সকল দুঃখের অবসান। হয়ত এ কথা সত্য, হয়ত নয়, হয়ত সত্যে-মিথ্যায় জড়ানো, কিন্তু এ কথাও কিছুতেই সত্য নয় যে, মানুষের কোন দিক দিয়েই দুঃখ দূর করার সত্যকার প্রচেষ্টা একেবারে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। যাঁরা রাজনীতি নিয়ে আছেন তাঁরা সর্বথা , সর্বকালেই আমাদের নমস্য। কিন্তু আমরা, সকলেই যদি তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবার সুস্পষ্ট চিহ্ন খুঁজে নাও পাই, যে দাগগুলো কেবল স্থূল দৃষ্টিতেই দেখতে পাওয়া যায়—আমাদের আর্থিক এবং সামাজিক স্পষ্ট দুঃখগুলো—কেবল এইগুলিই যদি প্রতিকারের চেষ্টা করি, বোধ হয় মহাপ্রাণ রাজনৈতিক নেতাদের স্কন্ধ থেকে একটা মস্ত গুরুভার সরিয়ে দিতে পারি।
তোমার দীর্ঘ অবকাশের প্রাক্কালে, তোমাদের অধ্যাপক এবং আমার পরম বন্ধু, শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র মহাশয়, এই শেষের দিকের অসহা বেদনার গোটা কয়েক কথা তোমাদের মনে করে দেবার জন্যে আমাকে আহ্বান করেছেন এবং আমিও সানন্দে তাঁর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি। এই সংযোগ এবং সম্মানের জন্য তোমাদের তোমাদের গুরুস্থানীয়দের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ দিই।
এই সভায় আমার ডাক পড়েছে দুটো কারণে। একে ত মৈত্রমশাই আমার বয়সের সম্মান করেছেন, দ্বিতীয়তঃ একটা জনরব আছে, দেশের পল্লীতে পল্লীতে, গ্রামে গ্রামে আমি অনেক দিন ধরে অনেক ঘুরেছি। ছোট বড়, উঁচু নীচু, ধনী নির্ধন, পণ্ডিত মূর্খ বহু , লোকের সঙ্গে মিশে মিশে, অনেক তত্ত্ব সংগ্রহ করে রেখেছি। জনরব কে রটিয়েছে খুঁজে পাওয়া শক্ত, এবং এর মধ্যে যত অত্যুক্তি আছে, তার জন্য আমাকেও দায়ী করা চলে না। তবে হয়ত, কথাটা একেবারে মিথ্যাও নয়। দেশের নব্বই জন যেখানে বাস করে আছেন সেই পল্লীগ্রামেই আমার ঘর। মনের অনেক আগ্রহ অনেক কৌতূহল দমন করতে না পেরে অনেকদিনই ছুটে গিয়ে তাঁদের মধ্যে পড়েছি, এবং তাঁদের বহু দুঃখ, বহু, দৈন্যের আজও আমি সাক্ষী হয়ে আছি। তাঁদের সেই সব অসহ্য , অব্যক্ত , অচিন্ত্যনীয় দুঃখ ও দৈন্য ঘোচাবার ভার নিতে আজ আমার দেশের সমস্ত নরনারীকে আহবান করতে সাধ যায়, কিন্তু কণ্ঠ আমার রুদ্ধ হয়ে আসে, যখনই মনে হয় মাতৃভূমির এই মহাযজ্ঞে নারীকে আহ্বান করার আমার কতটুকু অধিকার আছে! যাকে দিইনি, তার কাছে প্রয়োজনে দাবী করি কোন মাখে? কিছুকাল পূর্বে ‘নারীর মূল্য’ বলে আমি একটা প্রবন্ধ লিখি। সেই সময় মনে হয়, আচ্ছা, আমার দেশের অবস্থা ত আমি জানি, কিন্তু আরও ত ঢের দেশ আছে, তারা নারীর দাম। সেখানে কি দিয়েছে? বিস্তর পথিপত্র ঘেটে যে সত্য বেরিয়ে এল, তা দেখে একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। পুরুষের মনের ভাব, তার অন্যায় এবং অবিচার সর্বত্রই সমান। নারীর ন্যায্য অধিকার থেকে কমবেশি প্রায় সমস্ত দেশের পুরুষ তাদের বঞ্চিত করে রেখেছেন। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত তাই আজ দেশজুড়ে আরম্ভ হয়ে গেছে।
( ক্রমশ )