অনলাইন ডেস্ক : না, ভোটাভোটির প্রয়োজন হল না। আসলে পরিস্থিতির চাপে অজিত সিংহ সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক কোনও পদের জন্যই নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি। আর শেষ পর্যন্ত সভাপতি পদে আসীন হয়ে যান বিজেপির সাংসদ কৃপানাথ মালা এবং সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন ওই দলেরই কর্মকর্তা রাজদীপ গোয়ালা। অনেকটা সান্তনা পুরস্কার স্বরূপ কার্যকরী সভাপতির পদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হলো কংগ্রেসের তাবড় কর্মকর্তা অজিত সিংকে। আর এভাবে বরাক চা শ্রমিক ইউনিয়ন হয়তো গেরুয়াকরণের পথে এগিয়ে গেল আরও এক ধাপ।
সাধারণ সভার প্রথম দিন শনিবার শিলচর সদরঘাট রোডে ইউনিয়ন কার্যালয় চত্বরে সকাল থেকেই পরিস্থিতি ছিল সরগরম। বেলা ১১টা নাগাদ ইউনিয়ন কার্যালয় ভবনের দ্বিতলে নয়া কমিটি গঠনের জন্য শুরু হয় সভা। প্রায় ঘন্টা তিনেক ধরে সভা চলার পর আগামী পাঁচ বছরের জন্য গঠন করা হয় নতুন কমিটি। এতে কৃপানাথ মালা সভাপতি এবং
রাজদীপ গোয়ালা সাধারণ সম্পাদক এবং অজিত সিংহ কার্যকরী সভাপতি পদে আসীন হওয়ার পাশাপাশি দুজন সহ সভাপতি হয়েছেন সিউ নারায়ন রায় ও রাধেশ্যাম কৈরি, এবং চারজন সহকারী সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন সনাতন মিশ্র, রবি নুনিয়া, ক্ষীরোদ কর্মকার ও বিপুল কর্মী। সভার পর ইউনিয়নের কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমকে নতুন পদাধিকারীদের নাম জানিয়ে বলেন, নতুন কমিটি গড়তে ভোটাভুটির প্রয়োজন হয়নি। সর্বসম্মতিক্রমে ঐক্যের ভিত্তিতে গঠন করা হয়েছে কমিটি । ইউনিয়নের কর্মকর্তারা মুখে ঐক্য ও সর্বসন্মতির কথা বললেও সভায় কিন্তু দফায় দফায় সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনার। ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ কার্যসূচি হওয়ার দরুন কমিটি গঠন উপলক্ষে আয়োজিত এই সভায় সংবাদমাধ্যমকে যেতে দেওয়া হয়নি। তবে নিচে থেকে দফায় দফায় শুনা গেছে তীব্র হট্টগোলের আওয়াজ। এর পাশাপাশি নিচে জমায়েত বৃহৎ সংখ্যক লোকেদের মধ্যে থেকেও লাগাতার চলছিল রাজদীপ গোয়ালা ও কৃপানাথ মালার নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি সহ ভারত মাতা কি জয়, জয় শ্রীরাম ইত্যাদি স্লোগানবাজী। আর এসব স্লোগান যারা দিচ্ছিলেন তারা যে গেরুয়া শিবিরের লোক এ নিয়ে এনিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। যাদের মধ্যে দেখা গেছে বিজেপি এবং বজরং দলের কিছু অতি পরিচিত মুখও।
সভাস্থলে সংবাদমাধ্যমকে যেতে না দেওয়া হলেও বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, সভায় উপস্থিত প্রতিনিধিদের সিংহভাগই সোচ্চার ছিলেন কৃপানাথকে সভাপতি এবং রাজদীপকে্ সাধারণ সম্পাদক পদে অসীন করতে। কয়েকজন অজিত সিংহের হয়ে আওয়াজ উঠানোর চেষ্টা চালালেও সংখ্যাধিক্যের সম্মিলিত আওয়াজের সামনে তা চাপা চাপা পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত কার্যকরী সভাপতির মতো তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েই তা মেনে নিতে হয় অজিতকে। আর এই পদ পেয়ে তিনি যে সন্তুষ্ট নন, তা তো স্পষ্ট হয়ে গেছে তার আচরণেই।
কমিটি গঠনের পর কৃপানাথ, রাজদীপ সহ নতুন কমিটির অন্যান্য কর্মকর্তারা একযোগে সংবাদ মাধ্যমের সামনে হাজির হলেও গরহাজির ছিলেন অজিত। সভা শেষে বেরিয়ে যাবার পথে তাকে জিজ্ঞেস করলে বলেন, উধারবন্দে এক জরুরী সভা আছে তাই চলে যাচ্ছেন। আর সাংবাদিক সম্মেলনে তার গরহাজিরি নিয়ে রাজদীপ, কৃপানাথদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, অজিতবাবু হয়তো বাড়িতে খেতে গেছেন। যদিও সাধারণ সভা উপলক্ষে কার্যালয়েই ব্যবস্থা ছিল মধ্যাহ্নভোজনের।
ইউনিয়নের এক সূত্রে জানা গেছে, এমনটা যে পরিস্থিতি হতে পারে, তা আগেভাগেই আঁচ করে নিয়েছিল অজিত শিবির। তাই গতকাল শুক্রবার শেষ মুহূর্তে ওই শিবির থেকে একটা রফার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যাতে করে রাজদীপ সাধারন সম্পাদক হলেও কৃপানাথ যেন সভাপতি পদের লড়াই দাবি থেকে সরে যান। যাতে করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি হতে পারেন অজিত। কিন্তু রাজদীপ ও কৃপানাথদের শিবির এই প্রস্তাব মানতে রাজি হয়নি। তারা অজিতকে কার্যকরী সভাপতির পদ থেকে বেশি কিছু দিতে রাজি ছিলেন না। এই পরিস্থিতিতে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগাতে অজিতের কাছে ভোটাভুটির রাস্তায় যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও পথ ছিল না। কিন্তু ইউনিয়নের সদস্য ভোটারদের মতিগতি আঁচ করে তিনি সে পথে যাননি। সান্তনা পুরস্কার হিসেবে মেনে নেন কার্যকরী সভাপতির পদই।
ইউনিয়নের পদ দখলের লড়াই কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁচেছিল, এদিন তা টের পাওয়া গেছে ভালোভাবেই। গেরুয়া শিবিরের লোকেদের পুরো কার্যালয়ে ছেয়ে বসা ছাড়াও দেখা গেছে সদস্য ভোটারদের হাতে উপহার সামগ্রী তুলে দেওয়ার পালাও। এমনই একজন সদস্য জানিয়েছেন, এক পক্ষ থেকে পেয়েছেন ছোট প্লাস্টিকের ঝুড়ি ও মশারি এবং অন্য পক্ষ থেকে পেয়েছেন মোবাইল। এমন প্রাপ্তিযোগের দরুন করিমগঞ্জের এক বাগান থেকে আসা একজন সদস্য ভোটার খুশির চোটে বলে উঠেন-“পাঁচ বছর পরপর নয়, যদি প্রতিবছর হতো সাধারন সভা”। জানা গেছে সাধারণ সভায় সম্ভাব্য ভোটাভুটির কথা মাথায় রেখে বেশ কিছু সদস্য ভোটারকে রাখা হয়েছিল শিলচরের এক হোটেলে। যদিও এদিন ভোটাভুটির আর প্রয়োজন হয়নি। তবে হোটেলে থেকে উত্তম সব আহার উদরিকরণ এবং উপহার সামগ্রী প্রাপ্তির রেশ ধরে সভায় অনেকেই উৎসাহভরে করে গেছেন চিৎকার চেঁচামেচি।
এদিকে নতুন কমিটিতে সভাপতি বিজেপির সাংসদ কৃপানাথ মালা এবং সাধারণ সম্পাদক পদে ওই দলেরই কর্মকর্তা রাজদীপ গোয়ালার আসীন হওয়া সহ এদিন ইউনিয়ন চত্বরে সার্বিকভাবে যে পরিস্থিতি দেখা গেছে তা বোধহয় এটাই ইঙ্গিত করছে যে, ইউনিয়ন ক্রমেই এগিয়ে চলেছে গেরুয়াকরণের পথে।
যদিও কৃপানাথ, রাজদীপ বা সহকারি সাধারণ সম্পাদক সনাতন মিশ্ররা তা মানতে রাজি হননি। সনাতন মিশ্র বরং জোর গলায় বলেন, বরাক চা শ্রমিক ইউনিয়ন কখনোই কোনও রাজনৈতিক দলের লেজুড় ছিলনা, এবং হবেও না। ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের পৃথক রাজনৈতিক পরিচয় থাকতেই পারে। তবে ইউনিয়নে এর কোনও প্রভাব পড়বে না। এখানে সবাই ইউনিয়নের কর্মকর্তা, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। যদিও তাৎপর্যপূর্ণভাবে কৃপানাথ মালা বলেছেন,-“কেন্দ্র ও রাজ্য সর্বত্রই আমাদের সরকার। তাই এবার ইউনিয়নের কাজ চলবে আরও ভালোভাবে। সঙ্গে তিনি এও জানান, কমিটি গঠনের পরই সবকথা মোবাইলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে। আর রাজদীপ বলেন তারা শীঘ্রই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে অনুরোধ জানাবেন ইউনিয়ন কার্যালয়ে এসে কোনও কার্যসূচীতে যোগ দিতে।
এদিন সাধারণ সভাকে ঘিরে ইউনিয়ন কার্যালয়ে নিরাপত্তা রক্ষীদের সংখ্যাও ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে গেরুয়াপক্ষের সংখ্যাধিক্য থাকার দরুন সবকিছুই ছিল অনেকটা একতরফা। তাই নিরাপত্তারক্ষীদের বিশেষ সক্রিয় হতে হয়নি।