অনলাইন ডেস্ক ::দুই পক্ষই কিশোর, স্কুল পড়ুয়া ছাত্র। অথচ তাদের মধ্যে হওয়া ঘটনাকে কেন্দ্র করে রীতিমতো রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে গেল পশ্চিম কাছাড়ের কুশিয়ারকুলে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ারও অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস তেমন কিছু ঘটেনি। যদিও ‘সামান্য’ ওই ঘটনার রেশ ধরে পরবর্তীতে হওয়া কাণ্ডে ঘাম পড়লো পুলিশের, রক্ত ঝরলো একজনের। বিনিদ্র রাত কাটালেন কয়েকটি গ্রামের মানুষ। গ্রেফতারও হলেন ৪ জন। তবে কাছাড় পুলিশের সময়োপযোগী পদক্ষেপে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। জালালপুর, কুশিয়ারকুল, তালকর গ্রান্ট, বলেশ্বর ইত্যাদি গ্রাম এখন পুরোপুরি পুলিশি ঘেরাটোপে। নেই নতুন করে কোনও উত্তেজনা, উভয়পক্ষই এখন শান্তির পক্ষে সওয়াল করছেন। যতটুকু জানা গেছে, ঘটনার সুত্রপাত হয় ১৫ আগষ্ট, বলেশ্বর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের এক অনুষ্ঠানকে ঘিরে। স্কুল পড়ুয়া দুই কিশোরের মধ্যে ছাত্র সুলভ কোনও বিষয় নিয়ে বাকবিতণ্ডা, হয় হাল্কা ঠেলাধাক্কাও। এনিয়ে পরবর্তী সময়ে অভিবাবকদের মধ্যস্থতায় কিশোরদের ওই বিবাদের মিমাংসা হয়। এর কিছুদিন পর সেই পুরানো ইস্যুর জেরে আরেক দফা মারপিট হয় ছাত্রদের মধ্যে। তখনও আপোষ মীমাংসা হয়। এক পর্যায়ে থানায় মামলা হলে তার-ও সুরাহা হয়ে যায়। অনেকে ভাবছিলেন, কিশোর মনের ক্রোধ হয়তো থেমে গেছে, নিঃস্পত্তি হয়ে গেছে সবকিছু। কিন্তু সোমবার ঘটে গেল ফের অঘটন।
এলাকাবাসী বললেন, এদিন বিকেলে কুশিয়ারকুল বাজারে সেদিনের মারপিটে থাকা এক ছাত্রকে একা পেয়ে যায় অন্য পক্ষ। ব্যস, পুরনো জেদ মেটাতে এরা হামলে পড়ে সজল দাস নামের ছাত্রটির উপর। আবার অনেকে জানালেন, সোমবার যে ঘটনা ঘটেছে তাতে শুধু ছাত্র ছিল না। এখানে জড়িয়ে পড়ে তৃতীয় পক্ষ। ১৫ আগষ্টের ঘটনার পরই ওই তৃতীয় পক্ষের আবির্ভাব ঘটে ময়দানে। ফলে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ ছিল না। গ্রামীণ বিচার, আপোষ মীমাংসা ইত্যাদি বারবার হলেও কাজে আসছিল না কিছু। ফলে সোমবারে ফের মারপিঠের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তখনও এনিয়ে আপোষের পথে যেতে নেওয়া হয় সিদ্ধান্ত। পঞ্চাশ হাজার টাকা ‘আমানত’ রেখে মংগলবার বিচারেরও দিন ধার্য্য করা হয়। কিন্তু মঙ্গলবার আসার আগেই সোমবার রাতে ঘটে যায় লংকা কাণ্ড।
এলাকাবাসী বললেন, এদিন সন্ধ্যার পর থেকে খবর রটে, তালকর এলাকায় নাকি গাড়ি আটকে একপক্ষকে মারপিট করা হচ্ছে। রাত ৮টা নাগাদ সুযোগসন্ধানীরা রটিয়ে দেয়, একটি গাড়ি যাত্রী সমেত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। খবরটি যাচাই-বাছাই না করে কিছু লোক দাবানলের মতো ছড়াতে থাকেন। অন্যদিকে, অপরপক্ষেও একই ধরনের গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। রাত ৯টা বাজার আগেই এনিয়ে কুশিয়ারকুল বাজারের দুই পাশ তীব্র সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে ভরিয়ে দেওয়া হয়। পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসেন একপক্ষ, পুর্ব দিক থেকে অপর পক্ষ। খবর যায় গুমড়া পুলিশে। পরিস্থিতি আঁচ করে পুলিশ থেকে দুই সম্প্রদায়ের মাতব্বর লোকদের সাহায্য চাওয়া হয়। কালাইন থানা থেকেও ততক্ষনে রওয়া হয়ে যায় বাহিনী। এর আগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে কুশিয়ারকুল বাজারে পৌঁছেন কনক নাথ। তিনি ওই এলাকার উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ গ্রহনযোগ্য ব্যক্তি। তাঁর আশা ছিল, ঘটনাস্থলে পৌঁছলে পরিস্থিতি শান্ত করতে পারবেন তিনি। কিন্তু অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে সমাজকর্মী কনক নাথের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিছু দুর্বৃত্ত। এলোপাতাড়ি আক্রমণে কনকবাবুর মাথা ফাটলে রক্তে একশা হয়ে যান তিনি। এরইমধ্যে পুলিশ পৌঁছে যায় ঘটনাস্থলে। স্থানীয় কিছু লোক ও পুলিশের সহায়তায় কনক নাথকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।
এদিকে, সুযোগের সন্ধানে থাকা কিছু লোক ঘরে বসে ছড়াতে থাকে রটনা। ইন্ধন দিতে থাকে উভয় পক্ষে। এক সময় খবর রটে, উভয় সম্প্রদায়ের একাধিক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে গিয়েছে! যা ঘৃতাহুতি দেয় উত্তেজিত মানুষের মনে। ফলে কুশিয়ারকুল বাজারের পূর্ব দিক থেকে বেশ কিছু লোক ধাওয়া করেন পশ্চিম দিকে। ততক্ষণে গুমড়া সহ কালাইন ও কাটিগড়া থানা থেকে পুলিশের বেশ বড় দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। তারা উত্তেজিত লোকদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। এক সময় লাঠিচার্জ, এমনকি শূণ্যে এক রাউন্ড গুলিও ছুঁড়া হয় বলে খবর। তখন একদিকে রাত প্রায় ১১টা, অন্যদিকে পুলিশের রুদ্ররূপ দেখে পিছু হটেন আগন্তুকরা। যদিও কনক নাথ রক্তাক্ত হওয়ার পর বাজারের পশ্চিম দিকে অবস্থান নেওয়া লোকজন স্থান ত্যাগ করে নিয়ে ছিলেন। এবং তখনই পুরো এলাকা আয়ত্তে নিয়ে নেয় পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনী।
অন্যদিকে, রাত ১১টার পর কাছাড়ের পুলিশ সুপার নুমল মাহাত্তা আরও অতিরিক্ত বাহিনী নিয়ে কুশিয়ারকুল পৌঁছেন। সঙ্গে কমান্ডোও। সারা রাত তিনি ছিলেন ওখানে। রাতে পুরো এলাকাজুড়ে টহলদারি শেষে দিনের বেলা আস্ত এলাকা শান্ত দেখা গেছে। তবে মোতায়েন রয়েছে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী, আছে কমাণ্ডো ব্যটলিয়ানও। এদিকে, আইনশৃঙ্খলা অক্ষুণ্ণ রাখতে এবং কোনও ধরনের প্ররোচনায় পা না দিতে মংগলবার দুপুরে মাইক লাগিয়ে এলাকাজুড়ে আহ্বান জানায় পুলিশ। একইসঙ্গে মিটিং, মিছিল ইত্যাদিতেও জারি করা হয় নিষেধাজ্ঞা।
অন্যদিকে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে মংগলবার ভোর হওয়ার আগেই কনক নাথের উপর আক্রমণ করা সহ অন্যান্য অভিযোগে কুশিয়ারকুল, জালালপুরের সাবু, বাবুল সহ মোট ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশের এমন কঠোর পদক্ষেপে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বৃহত্তর অঞ্চলের মানুষ। বলাবাহুল্য, ঘটনার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সক্রিয় হয়ে ছিলেন। অনেকে পুলিশকে সাহায্য করেছেন। কাটিগড়ার বিধায়ক খলিল উদ্দিন মজুমদার এবং শিলচরের সাংসদ পরিমল শুক্লবৈদ্যও পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা এলাকার সম্প্রতি বজায় রাখারও আহ্বান জানিয়েছেন। লক্ষনীয় বিষয়, মংগলবার উভয় সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে সেই আগের মতোই ভ্রাতৃত্ববোধ লক্ষ্য করা গেছে। তাঁরা সর্বাবস্থায় কুশিয়ারকুল, জালালপুর, তালকর গ্রান্ট ইত্যাদি এলাকার সম্প্রতি অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইছেন।