সাময়িক প্রসঙ্গ অনলাইন ডেস্ক
শিলচর : স্বাধীনতা আন্দোলনে বরাক উপত্যকার গৌরবময় ভূমিকার নানাদিক এখনও অনালোচিত। এই উপত্যকার সংগ্রামী ধারাকে সঞ্জীবিত করতে জাতীয় নেতারা বারবার ছুটে এসেছিলেন। বিপিনচন্দ্র পাল থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী, সৌকত আলি, জওহরলাল নেহরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সহ আরো বহু প্রখ্যাত নেতার আশীর্বাদ পেয়েছিলেন এই উপত্যকার স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। গত ১৪ আগস্ট স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে অমৃত মহোৎসব উদযাপন এবং বিভাজন বিভীষিকা স্মৃতি দিবসের আলোকে শিলচর বঙ্গভবনে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতি আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিশিষ্ট গবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য এসব তথ্য তুলে ধরেন।
বরাকবঙ্গের কাছাড় জেলা সমিতির সভাপতি সঞ্জীব দেব লস্করের পৌরোহিত্যে অনুষ্ঠিত ওই আলোচনা সভায় অমলেন্দুবাবু বলেন, উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই এই ভূমিতে দেশপ্রেমের স্ফুরণ ঘটেছিল, যার ভিত তৈরি করে দিয়েছিল সাহিত্যচর্চার সবল ধারা। এ প্রসঙ্গে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমসাময়িক রামকুমার নন্দীর লেখনীর কথা উল্লেখ করেন। বলেন, ১৮৯২ সাল থেকেই এখানে দেশকে নিয়ে গর্ববোধ করার মনোভাব তৈরি হতে শুরু করে এবং পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি ধারায় এই অঞ্চল সাড়া দিয়েছিল। কামিনীকুমার চন্দের নেতৃত্বাধীন ‘কাছাড় স্বদেশী সভা’-র কথা উল্লেখ করে অমলেন্দুবাবু বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনকে ব্যাপক স্তরে নিয়ে যেতে হলে মেয়েদের তাতে যুক্ত করা যে অপরিহার্য সে ভাবনা তখন থেকেই শুরু হয় এবং বিপিনচন্দ্র পাল যখন বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় জনমত গঠনে শিলচরে এসেছিলেন তখন পর্দার আড়ালে মেয়েদেরও তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ শোনার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বিপিনচন্দ্র পালের সফরের পরেই বরাক উপত্যকায় স্বাধীনতা আন্দোলনকে তৃণমূল স্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পিত প্রয়াস শুরু হয়।
সিপাহী বিদ্রোহ থেকে চরগোলা এক্সোডাসের ঘটনাক্রম টেনে এনে তিনি বলেন, ১৯২১ সালের আগস্টে মহাত্মা গান্ধী, সৌকত আলির শিলচর সফরের সময় থেকে এই অঞ্চলে স্বাধীনতা সংগ্রাম আরো পরিব্যাপ্ত হয়। এরই সূত্র ধরে ১৯৩৭ সালে জহরলাল নেহেরু এবং ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু শিলচর তথা এই উপত্যকা সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, এখানকার ভট্ট সঙ্গীতে সে সময় জাতীয় চেতনার প্রভাব দেখা যায়। সুরমা সাহিত্য সম্মিলনীর ভূমিকার কথাও তিনি তুলে ধরেন। দেশভাগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, অখন্ড ভারতকে দু টুকরো করার যখন চেষ্টা শুরু হয় সে সময় এই অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা তাতে আপত্তি তুলেছিলেন। সিলেট গণভোটের সময়ও তাদের বিরোধিতা করতে দেখা গেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এর আগে আলোচনার প্রারম্ভিক বক্তব্যে বরাকবঙ্গের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গৌতমপ্রসাদ দত্ত বলেন, ১৮৩২ সালের ১৪ আগষ্ট কাছাড় বৃটিশ মানচিত্রে আসার পর এখানকার প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন শুরু হয়। ১৮৭৪ সালে সিলেট কাছাড় যখন অসমের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন এখানেও তার বিরোধিতা হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের সবগুলো ধারায় সক্রিয় এই উপত্যকা দেশভাগ ও সিলেটকে পাকিস্তানে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্তের বিরোধিতা করেছে। তখনই আশঙ্কা করা হয়েছিল বাঙালির আত্মপরিচয় সহ সব অধিকার বিপন্ন হতে পারে। সেদিনের আশঙ্কা আজ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালিকে একদিকে বিদেশি তকমা সেটে রাষ্ট্রহীন করার চেষ্টা, অন্যদিকে অ-ভূমিপুত্র ধুয়ো তুলে অর্থনৈতিক ও জমির অধিকারও কেড়ে নিতে পদ সঞ্চালন শুরু হয়েছে। এতে এই জাতিগোষ্ঠীর উত্তর প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।
সভাপতি সঞ্জীব দেবলস্কর স্বাধীনতা সংগ্রামে এই অঞ্চলের সংগ্রামীদের বিস্তৃত তালিকা তুলে ধরে যথার্থ ইতিহাস অনুসন্ধানের আহ্বান জানান।অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জেলা সম্পাদক জয়ন্ত দেবরায়। এ উপলক্ষে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশ নেন পঙ্কজ নাথ, মঙ্গলা নাথ, তাহেরা বেগম লস্কর, শান্তশ্রী সোম এবং দিশারী ও স্বরলিপি সাংস্কৃতিক সংস্থা। এদিকে স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন বরাকবঙ্গের জেলা সভাপতি সঞ্জীব দেবলস্কর। এ উপলক্ষে বক্তব্য রাখেন জেলা সভাপতি দেবলস্কর, কেন্দ্রীয় সমিতির সহ সভাপতি ইমাদউদ্দিন বুলবুল, প্রাক্তন জেলা সভাপতি তৈমুর রাজা চৌধুরী, কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গৌতমপ্রসাদ দত্ত, কেন্দ্রীয় সমিতির সদস্য সীমান্ত ভট্টাচার্য ও জেলা সহ সভাপতি বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য। সঞ্চালনায় ছিলেন জেলা সম্পাদক জয়ন্ত দেবরায়। সঙ্গীত পরিবেশন করেন বরাকবঙ্গের সদস্যরা।