সঞ্জীব দেবলস্কর
ভাষা আন্দোলন আসামে একটি দীর্ঘকালীন চলমান আন্দোলন, যার দায়ভার আপাতত বরাক উপত্যকার বাঙালিকেই বইতে হচ্ছে। ১৯৮৫ সালে সম্পাদিত আসাম চুক্তি, এবং এরই সূত্র ধরে ২০১৩ সালে ভারত সরকার প্রকাশিত গ্যাজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে (২ আগস্ট, ২০১৩) নাগরিকপঞ্জি নবায়নের সিদ্ধান্ত, এরই সঙ্গে হাত ধরে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী প্রস্তাব (২০১৬ সালে), এ সব কিছুই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ১৯৬০ সালে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের ফলশ্রুতি। বরাক উপত্যকায় এ আন্দোলনের প্রাপ্তি অবশ্য একটিই একষট্টির ‘আসাম সরকারি ভাষা আইন-১৯৬০’-এর ‘সংশোধনী’ (১৯৬১), যেখানে প্রতিরোধের কাছে নতি স্বীকার করে বাংলা ভাষার জন্য একটা রক্ষাকবচের সংস্থান রাখা হয়েছে—Section 5. Safeguard of the use of Bengali language in the disatrict of Cachar। এ রক্ষাকবচের জোরে বরাক সহ সারা রাজ্যে বাংলাভাষা এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু বিচক্ষণতার সঙ্গে এ ধারাকে পাশ কাটিয়ে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে কী ভাবে সংকুচিত করা হচ্ছে এ নিয়ে বর্তমান লেখকের ইতিপূর্বে একাধিক নিবন্ধ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। (“মাধ্যমিক স্তরে আবশ্যিক অতিরিক্ত সপ্তম পত্র: আধিপত্যবাদের ‘জিজিয়া’ কর” ইত্যাদি) ৩১ মার্চের ২০২১ ‘দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ’ পত্রিকায় এ নিয়ে একটি নিবন্ধে আমি বলেছিলাম আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ ওই নির্দেশনামায় সুপরিকল্পিত ভাবেই ৬১ সালে ‘শাস্ত্রী ফর্মুলা’ অনুযায়ী বরাক উপত্যকার (সঙ্গে ৬ষ্ঠ তপশিলের অন্তর্গত অঞ্চলের নিজস্ব ভাষার) জন্য বাংলাভাষার স্বীকৃত অধিকারের ধারাগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে অবিকৃত রেখেই (বাঙালিদের) মাতৃভাষার এই বিশেষ (৫ নম্বর ধারা মতে) অধিকার কেঁড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে। যারা শাস্ত্রী ফর্মুলার দোহাই দিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে রয়েছেন, এরা বুঝতেই পারছেন না ভিন্নতর কৌশলে রক্ষাকবচের আওতায় থাকা অঞ্চলে ভাষিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস এখন প্রবল। এটা উপলব্ধি করাটাও উনিশের উত্তরাধিকারীদের দায় ও দায়িত্ব।
রাজ্যের অন্যতম প্রধান ভাষিকগোষ্ঠী বাঙালি যে আজ ভেতরে বাইরে আক্রান্ত, এটা অবশ্য সঠিক ভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা বাঙালি হারিয়ে যেতে বসেছে। বাঙালি ভুলে যেতে চলেছে দেশবিভাগের চরম শাস্তি তাঁকে আজও তাঁকেই ভোগ করতে হচ্ছে। ওপারে পূর্ববঙ্গের বাঙালি অবশ্য চব্বিশ বছরের অনন্ত নরকযন্ত্রণা ভোগ করার পর দ্বিজাতিতত্ত্বের খোয়ারি কাটিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম একটা জাতিরাষ্ট্র গড়ে মুক্তির স্বাদ পেয়েছে (এর পরবর্তী পরিস্থিতিকে কী ঘটছে এটা আলোচনার প্রয়োজন নেই), কিন্তু এপারের বাঙালি, বিশেষ করে সম্প্রসারিত বাংলা, রবীন্দ্র কথিত ‘নির্বাসিত বাংলা’, অর্থাৎ বরাক উপত্যকা এবং সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি অদ্যাবধি সেই হিংসা, ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষবাষ্প মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। এর ফলে নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলে নতুন পরিস্থিতি অনুযায়ী একটি প্রতিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা এদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
দেশবিভাগের অব্যাহত পূর্ব এবং পরে বিরাট সংখ্যক বাঙালি (হিন্দু- মুসলিম উভয়ই) নিজেদের মধ্যে হানাহানি, দাঙ্গা, রক্তপাত সংঘটিত করে প্রাণ হারিয়েছে, এ ইতিহাস আমাদের জানা। কিন্তু আসাম রাজ্যে গত শতকের চার, পাঁচ, ষাট, সত্তর, আশি, নব্বুই এবং একবিংশ শতকের দু’টি দশকে দাঙ্গায় প্রাণ হারানো বাঙালির সংখ্যা যে পূর্বেকার সংখ্যাকে ছাপিয়ে গেছে এ ইতিহাস আমরা জানি না। আমাদের চর্চার মধ্যে অনেক কিছু থাকলেও এ বিষয়টি আপাতত অস্পষ্ট।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্টের পর যে সব পূর্ববঙ্গের মানুষ গণভোটে আসামের পক্ষে ভোট দিয়েও ‘উদ্বাস্তু’ অভিধা মাথায় নিয়ে আসামে এসে আশ্রয় নিলেন এদের উপর সংঘটিত অমানবিক অত্যাচারের কোন নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান, তথ্য সংগ্রহ করে রাখা হয়নি। স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, ১৯৪৮ সালের এপ্রিল-মে মাসে গৌহাটি শহরে বাঙালির উপর সংঘটিত আক্রমণ প্রতিহত করতে সেনাবাহিনীও নামাতে হয়েছিল। মারপিট, ছুরিকাঘাত, দোকানপাট ভাঙচুর, বাসগৃহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ঘটেছিল গৌহাটি শহরের বুকেই, অবশ্য এর মাত্র দুইটি হত্যাকাণ্ডই সরকারি নথিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। নথিবদ্ধ হয়েছে ২০ মে-তে গৌহাটিতে রেলওয়ে কর্মী উমেশচন্দ্র দাশগুপ্তের মৃত্যু। তাছাড়া ২৩ মে নওগাঁয় বাঙালি স্কুলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ছাড়া অসংখ্য আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৫০ সালে ধুবরি, বরপেটা, বঙ্গাইগাও, অভয়াপুরি, চাপর, বিলাসীপাড়ার দাঙ্গা, ১৯৫৫ সালের দাঙ্গা ছাড়াও ১৯৫০ সালে নিম্ন আসামে ‘এলানি মিঞাঁ মুসলিম বিরোধী গণহত্যা’ (দে.শর্মা, পৃ.৮৩), এবং ৩,৫০,০০০ মানুষ বিতাড়ন, ১৯৬০ সালের ২০ জুন থেকে মরিয়ানি, অতঃপর শিবসাগর, লামডিং, ডিব্রুগড়, গোলাঘাট, তিতাবর, পাণ্ডু, যোরহাট, নাহারকাটিয়া, আমগুড়ি, নওগাঁ, গোরেশ্বর প্রভৃতি স্থানে হাঙ্গামা এবং লিপিবদ্ধ না হওয়া মৃত্যুর সংখ্যা খুব কম হবে না। সর্বমোট হতাহতের সংখ্যা হাজার ছয় সাত হবে তো নিশ্চয়ই। তবে ১৯৬০-৬১ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত একেবারে নামধাম সহ ১৩০ জন শহিদের একটি তালিকাও ইতিমধ্যে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। এটা প্রণয়ন করেছেন দিয়েছেন কোনও বাঙালি সংগঠন বা বুদ্ধিজীবী নয়, খোদ অসমিয়া ‘জাতীয় অভিধান প্রণেতা’, সমাজসেবী ডা. দেবব্রত শর্মা এবং দয়াসাগর কলিতা (অসমিয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া: ১৯৬০ চনর ভাষা আন্দোলন, যোরহাট, ২০২০, পৃ. ৪৮৩-৪৯২)। এই তালিকায় অবশ্যই এরা শিলচর রেলস্টেশনে পুলিশের গুলিতে নিহত একাদশ শহিদদেরও সসম্মানেই স্থান দিয়েছেন।
১৯৭২ সালে করিমগঞ্জে ১ জন এবং ১৯৮৬ সালে আরও ২ জন ছাড়াও বাহাত্তরের ভাষা আন্দোলনের শহিদের সংখ্যাও যোগ করলে তালিকা দীর্ঘ হবে। আর ১৯৮৩ সালে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গোরেশ্বর, খৈরাবাড়ি, শিলাপাথার, চামারিয়া, ধুলা, সিপাহঝার, জামাগুড়িহাটে গণহত্যা এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নওগাঁ জেলার ভোগডুবাহাবি, ভোগডুবা বিল, আলিশিঙা, মাটি পর্বত, ১নং মূলাধারি, ২ নং মূলাধারি, শিলভেটা, বরিজলাহ, ভাতানিমারা, এন্দুমারি, ভাইতাতি, বড়বাড়ি, মিকির ভেটা এবং নেলি এই চৌদ্দটি গ্রামে একই সঙ্গে রক্তক্ষয়ী আক্রমণ সংঘটিত হল। সরকারি তথ্যানুসারে ১৮১৯ জন নিহতকে সনাক্ত করা হয়েছে। বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে মৃত বাঙালির সংখ্যা তো ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে ২০১০ বরপেটায় নিহত ৫জন প্রতিবাদকারী (২১ জুলাই), ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রতীক হাজেলার নেতৃত্বে নাগরিকপঞ্জি নবায়ন প্রক্রিয়া শুরু বরার পর একে একে প্রায় ১০০ জন শহিদ (বলা যায় এন-আর-সি শহিদ), আর ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর তিনসুকিয়ার ধলাসদিয়ায় নির্মম গণহত্যার ৫ শিকার—এ তো দীর্ঘ মৃত্যু মিছিল। বলছিলাম আসামে বাঙালিদের উপর সংঘটিত হত্যাকাণ্ড দেশবিভাগের সময়কালীন নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডকে ম্লান করে দিতে না পারলেও দেশ বিভাগের হত্যাকাণ্ডকে ছাপিয়েও গেছে। বিষয়টি যে সংবেদনশীল অসমিয়া লেখককেও বিচলিত করেছে এই তথ্যটি এখানে তুলে ধরা হল এ জন্যই যে আসামের বাঙালি মাঝে মাঝেই নিজেদের উপর সংঘটিত এ সন্ত্রাসের কথা ভুলে গিয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞে যারা আজও ঘৃতাহূতি দিচ্ছেন এদের সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছেন।
আজ যাঁরা নতুন করে ধর্মীয় উন্মাদনায় দীক্ষিত হয়ে (এদের মধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় রয়েছেন উদ্বাস্তু বাঙালি হিন্দুরাও) আগামী দিনের জন্য এক চিরস্থায়ী অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করতে চলেছেন এদের অসমিয়া জাতীয় অভিধান প্রণেতা বিদগ্ধ সমাজচিন্তক ড. দেবব্রত শর্মার কথাগুলো শোনা প্রয়োজন। কী জানি হত্যাকাণ্ডের ৩৯ বছর পর তাঁর ওই আর্তনাদ আজকের দিনে এদের বিচলিত করবে কি না:
নেলির বধ্যভূমিতে নীরবে নিভৃতে শুয়ে থাকা সহস্রাধিক ফুলের মতো কচি শিশুর ছবির দিকে তাকিয়ে আজ পঁচিশ বছর পেরিয়ে হলেও অসমিয়া জাতিকে অশ্রুপাত করতে হবে। তা না করলে আমরা এক শিশু হত্যাকারী জাতিতে পরিণত হব।
সেদিনের নিষ্ঠুরতার কথা এই লেখকের বয়ানে ধরা আছে:
…চাউলখোয়া চরের ঘটনাই ধরা যাক্। সেখানে কদিন পর ১৯০ টি কচি শিশুর পঁচা গলা মৃতদেহ পাওয়া গেছিল। সেগুলো গুলি করে বা গলা কেটে খুন করা শিশুর মৃতদেহ ছিল না। তার বদলে হাত পা কেটে রক্তক্ষরণ হয়ে তিলে তিলে মারবার জন্য তাদের ফেলে রাখা হয়েছিল। আন্দোলনের সময় চালানো প্রবল প্রচারের এক বুলি ছিল এ রকম: সাপের কোন ছোট বড় নেই।
তাঁর পরবর্তী বাক্যগুলোও উদ্ধার করা প্রাসঙ্গিক:নেলির রক্তাক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে অসমিয়া জাতি যে অবধি গভীর অনুশোচনায় অশ্রুপাত না করবে, সে অবধি একুশ শতকের অসমিয়া জাতিগঠনের প্রক্রিয়ার কোন শুভারম্ভই হবে না। (ড.দেবব্রত শর্মা, ভূমিকা, নেলি, ১৯৮৩, দিগন্ত শর্মা, ২০০৫, শিলচর, অরুণোদয় ও একলব্য প্রকাশন)
এই যে মানবিক উপলব্ধি এ থেকে আসামের বাঙালির, উনিশে মে’র ভূমি বরাক উপত্যকারও শেখার আছে। যে নৃসংশতাকে উপেক্ষা করে রাজ্যের জনগণ একের পর আরেক নৃসংশতাকে প্রশ্রয় দিয়ে ক্রমাগত গুপ্ত দাঙ্গার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছেন এদের মধ্যে যে বাঙালিরাও রয়েছেন বিপুল সংখ্যায় এটাই বিশেষ করে লক্ষণীয়। দেশবিভাগ থেকে এরা কোন শিক্ষাই গ্রহণ করেনি। যে কারণে একটা অখণ্ড জাতি দুই বিবদমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হল এর মূলে যে রয়েছে ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, এটা বোঝার দায়ও ভাষা আন্দোলনের উত্তরাধিকারীর উপরই বর্তায়।
যারা সাময়িক লাভের কথা ভেবে রাজনীতি করেছেন, যারা উগ্রজাতীয়তাবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, যারা নিজের ভাষিকসত্তা বিসর্জন দিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে চেয়েছেন, যারা ধর্মীয় বিভাজন এবং বিভেদের দর্শনকে মনেপ্রাণে লালন করেছেন—এরা সবাইই যে এক মহাসংকটে আছেন তা বোঝার ক্ষমতা এরা হারিয়েছেন বলা মোটেই অসঙ্গত হবে না। এ এমনই দারুণ সংকট যে বাঙালি পায়ের নিচের ভূমি সরে যাচ্ছে দেখেও সত্যটি মানতে পারছেন না, নিজ মাতৃভূমিতে তাদের নাগরিকত্ব আজ সত্যিই প্রমাণসাপেক্ষ।এখনও ভাবছেন কোনও এক অদৃশ্য কারণে ওদের নিরাপত্তা, শান্তি নিশ্চিত হবে।
এই অলীক স্বপ্নের ঘোরে আচ্ছন্ন বাঙালিরা। আজ প্রকৃতপক্ষে যে এ রাজ্যে সমাজ, জাতি এবং রাষ্ট্রগঠন, এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনেও বাঙালির ভূমিকা অস্বীকার করা হচ্ছে, এটা এরা অনুভব করতে পারছেন না। বিদেশী শনাক্তকরণ, বিতাড়ন, নাগরিকপঞ্জি নবায়ন, নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী, আসাম চুক্তির ৬ নম্বর ধারা রূপায়ন প্রয়াসের প্রেক্ষিতে আসাম এবং সারা দেশেই ( সারা বিশ্বেও) বাঙালির পরিচিতিটি ঝাপসা করে দেওয়া হয়েছে। এ সমস্যা আজ এত গভীর যে বাঙালির মধ্যেই সংশয় জেগে গেছে, এদের নাগরিকত্ব বুঝি সত্যই প্রামাণসাপেক্ষ, আসাম রাজ্যে তাঁদের ভাষিক অধিকার বুঝি খুব একটা অতিরিক্ত দাবি।
বাঙালিদের সংখ্যাকে উপেক্ষা করেই বড়ো ভাষাকেই রাজ্যের সহযোগী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হল এ নিয়ে বাঙালিদের যেন কিছু বলার থাকতে পারে না। অনেকেই ভাবা শুরু করেছেন, বাঙালিদের সঠিক আত্মপরিচয় হল ‘বঙ্গভাষী-অসমিয়া’ (এক ধরনের সোনার পাথরবাটি আরকি); অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন বাঙালিদের নিজস্ব অভিজ্ঞানসমূহ (উত্তরীয় ইত্যাদি), নিজস্ব উৎসব, আমোদপ্রমোদ, নৃত্যকলা, পোশাকআশাক সমস্তকিছুই রাজনৈতিক ক্ষমতায় বলীয়ান জনগোষ্ঠীর ইচ্ছাধীন। এই মানসিকতা জনজীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলে আর সে সঙ্গে রাজ্য ভাষাআইনের ৫ নম্বর ধারার অন্তর্গত অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিত্বে বাঙালিদের স্থান সংকুচিত করে আনা হলেও বাঙালির কোন হেলদোল দেখা যাবে না, সরকারি চাকরিতে বাঙালিদের দূরে ঠেলে রাখলেও কোন ক্ষোভ সঞ্চারিত হবে না, ‘ব্রহ্ম কমিশন’-এর সুপারিশ অনুযায়ী বাঙালির জমির অধিকার সংকুচিত করলেও আত্মবিস্মৃত বাঙালির আত্মতৃপ্তি থাকবে যে, এতে করে ‘একটি বিশেষ’ জনগোষ্ঠীর ক্ষমতা সংকুচিত তো হবে। এই আত্মবিস্মৃতির পথ ধরেই স্কুলকলেজে ঘোরাপথে বাংলাভাষাকে সংকুচিত করা, ইচ্ছাকৃত ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, জনতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্বে বিকৃতির স্বরূপ উপলব্ধি করার ক্ষমতাই বাঙালি হারিয়ে ফেলবে।
ভবিষ্যতে রাজ্যে সংখ্যাগুরুত্ববাদের অর্থাৎ, majoritarianism এর প্রবল জোয়ারে আরও বেশি সংখ্যক মুক-বধির জনপ্রতিনিধি তৈরি করে রাজ্য ভাষাআইনে যে সংখ্যালঘু ভাষার জন্য সংস্থান রাখা হয়েছে এর উপরও যে হস্তক্ষেপ করার প্রয়াস দেখা যাবে না এর কোন স্থিরতা আছে কি? ভাষা আন্দোলনের চেতনা, উনিশের উত্তরাধিকার, শহিদের রক্তস্রোত—এসব তখন যে-কবিতার অনুপ্রেরণা যোগাবে এর গ্রহীতা কে হবে এটা এ সময়ের বাঙালিকেই বুঝে নিতে হবে।
এবার যুদ্ধ নিজের ঘরে, নিজের বিরুদ্ধে। প্রতিপক্ষ এখন আর দিল্লি দিসপুরের নয়, বাংলা এবং বাঙালির প্রতিপক্ষ এখন বাসা বেঁধেছে বাঙালির মনের ভেতর। হিংসা বিভেদের দর্শনে আস্থাশীল বাঙালি ভাষিক-আগ্রাসনে স্বেচ্ছাসম্মতির দিকে এগিয়ে গেলে অবশ্য সাহিত্য সংস্কৃতি আর ভাষিক অভিমান নিয়ে উনিশের রক্তমাখা ভূমিতেই তাঁকে নির্বাসিত জীবনই বরণ করতে হবে। আপাতত এই সত্যটা উপলব্ধি করাই উনিশের দায় এবং দায়িত্ব।