অনলাইন ডেস্ক : বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডকে ঘিরে শনিবার শিলচর শ্যামাপ্রসাদ রোড (শিলংপট্টি)-এ সৃষ্টি হয় আতঙ্কময় পরিস্থিতির। আগুনের বেড়াজালে ফেঁসে প্রানরক্ষার জন্য উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন এক যুবতী। আহত হয়েছেন উদ্ধার অভিযানে যাওয়া দুর্যোগ মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের দুই “আপদামিত্র’ও। শহরের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত শিলংপট্টিতে গড়ে ওঠা একের পর এক বহুতল ভবন ব্যবহার হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। প্রায় প্রতিটি ভবনেই রয়েছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অর্থ প্রতিষ্ঠান সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে ছোট লাল শেঠ ইনস্টিটিউট-এর বিপরীত দিকে থাকা “বসুন্ধরা” নামে পাঁচতলা বিশিষ্ট ভবনে। ওই ভবনের নিচের তলায় রয়েছে কিছু দোকান। এরপর পর্যায়ক্রমে এরউপরের তলাগুলোতে রয়েছে ব্যাঙ্ক অব বরোদা, মাহিন্দ্র ফাইন্যান্স ইত্যাদি সংস্থার শাখা। আগুন লাগে পঞ্চম তলে থাকা ইনস্টিটিউট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি (আই আই আই টি) নামে এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ যখন অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত ঘটে, তখন আই আই আই টি তে চলছিল প্রশিক্ষার্থীদের ক্লাস। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আগুন লাগার পর আতঙ্কে শুরু হয়ে চিৎকার-চেচামেচি। আই আই আই টির দরজার কাছে থাকা কয়েকজন দ্রুত সিড়ি নিচে নেমে যান। তবে ভেতরের দিকে যারা ছিলেন ব্যাপারটা অনুধাবন করে তারা বেরিয়ে আসতে আসতে আগুন অনেকটা বেড়ে যায়। নিচে নেমে আসার জন্য সিঁড়ি ধোয়ায় ভরে গিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এই অবস্থায় কয়েকজন প্রাণ বাঁচাতে সিঁড়ি দিয়ে চলে যান উপরে ছাদে। ছাদে গিয়েও দেখতে পান আগুন জ্বলছে উপরে স্টোররুম হিসেবে ব্যবহৃত আসাম টাইপের ছোট ঘরেও। ছাদের উপরে রয়েছে তিনটি মোবাইল টাওয়ারও। প্রাণ বাঁচাতে যারা ছাদে দিয়েছিলেন সেখানে গিয়েও আগুন জ্বলতে দেখে তাদের কয়েকজন রড ও পাইপ বেয়ে পাশের ত্রিতল ভবনের ছাদে নেমে যান। ঝাপিয়েও পড়েন কয়েকজন।তবে আটকে যান মহিলাদের বেশিরভাগই। তারা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকেন।এসবের মাঝে উধারবন্দ বাহাদুরপুর এলাকার বাসিন্দা হর্ষিতা সিং (১৯) নামে এক প্রশিক্ষার্থী যুবতী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পাশের ওই ত্রিতল ভবনের ছাদে থাকা টিনের ঘরের চালে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ঝাপিয়ে পড়ার পর টিনের চাল ভেঙ্গে তিনি গড়িয়ে পড়ে বেশ আহত হন।
এসব ঘটনাক্রমের মাঝে গোটা এলাকায় আতঙ্কে শুরু হয় দৌড়ঝাপ। ভবনটির অন্যান্য তলায় থাকা বিভিন্ন কার্যালয়ে যারা ছিলেন তারাও দৌড়ে নিচে নেমে যান। যদিও এর মধ্যেই সাহস করে আশপাশের কিছু যুবক আটকে পড়া মহিলা প্রশিক্ষার্থীদের উদ্ধারের জন্য উঠে পড়েন পাশের ভবনের ছাদে। তারা সিঁড়ি লাগিয়ে এই মহিলাদের পাশের ভবনের ছাদে নামিয়ে আনতে শুরু করেন। এসবের মাঝে পৌঁছান দুর্যোগ মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের কয়েকজন আপদামিত্র, হাজির হয় দমকল বাহিনীও। সম্মিলিতভাবে তৎপরতা চালিয়ে আটকে পড়া সবাইকে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়। আর এই উদ্ধার অভিযানের সময় আহত হন দুই আপদামিত্র অজয় মালা এবং দিলোয়ার হোসেন লস্কর। আটকে পড়া লোকেদের নিচে নামিয়ে আনার পর দমকল বাহিনী জল ছিটিয়ে প্রায় দু’ঘণ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। সব মিলিয়ে কাজে লাগাতে হয় ৮টি দমকল গাড়ি।
আইআইআইটির স্বত্বাধিকারী তথা পরিচালক কালিপদ দাস জানিয়েছেন, হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠতে দেখে তারা হকচকিয়ে যান। সেসময় প্রশিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষক সহ অন্যান্য কয়েকজন মিলিয়ে তারা ছিলেন প্রায় ২০-২৫ জন। তিনি জানান, আগুনের সূত্রপাত তাদের কার্যালয়ে না উপরে ছাদে থাকা স্টোররুম থেকে হয়েছে এ নিয়ে তিনি নিশ্চিত নন। তবে আগুনে কার্যালয়ে থাকা অর্ধশতাধিক কম্পিউটার সহ বই ও বেশ কিছু আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যদিও মূল কার্যালয়ের পাশে প্রশিক্ষার্থীদের নথিপত্র থাকা ঘর অক্ষত বেঁচে গেছে বলে জানান তিনি।
পাঁচতলা ওই বহুতল ভবনের চতুর্থ তলেও রয়েছে এমন দুটি প্রতিষ্ঠান, যেসব প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরমধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান “এনআই সি এ@এডুকেশন”-নামের প্রতিষ্ঠানেও সে সময় প্রশিক্ষার্থীদের ক্লাস চলছিল। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বিক্রম রায় পোদ্দার জানান, উপরের তলায় আইআই আইটিতে আগুন লাগার পর তাদের প্রশিক্ষার্থীরা সবাই অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে যেতে সক্ষম হন। তবে আগুন নেভানোর জন্য দমকলবাহিনীর ছেটানো জল নিচে নেমে এসে তাদের কিছু নথিপত্র নষ্ট হয়েছে। অন্য প্রতিষ্ঠান ইগনাইট এডুকেশন-এর কর্মকর্তা হিলাল আহমদ লস্কর জানান, ঘটনার সময় তাদের প্রতিষ্ঠানের কোনোও প্রশিক্ষার্থী ছিলেন না।
এদিনের এই অগ্নিকাণ্ডকে ঘিরে প্রশ্ন উঠছে, যে ভবনে রয়েছে বরোদা ব্যাংকের শাখা সহ এতো এতো প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, সেই ভবনে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য কোনও অতিরিক্ত ব্যবস্থা কেন নেই। কোনোওভাবে সিঁড়ি বন্ধ হয়ে পড়লে তো আর বের হওয়ার কোনও পথই নেই। যা দেখা গেছে এদিনই। আর ভবনে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাই বা রয়েছে কতটুকু।
এ নিয়ে ভবনের সত্বাধিকারী প্রাক্তন পুরপতি শান্তনু দাসকে জিজ্ঞেস করলে, তিনি জানান ভবনটি তৈরি করা হয়েছে ২০০০ সালে। শিলচর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে তৈরি করা হয়েছে ভবন। সে সময় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য কোনও অতিরিক্ত রাস্তা নির্মাণের কথা বলেননি। অনুমতি নিয়ে সম্পূর্ণ বৈধভাবেই ভবন নির্মাণ করিয়েছেন তিনি। আর ভবনের প্রতিটি তলায় রয়েছে চারটি করে “ফায়ার এক্সটিংগুইসার”।
শিলচর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার ডি এইচ চৌধুরী জানান, ঘটনা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। আগুনের কিভাবে সূত্রপাত ঘটেছে এ নিয়ে তারা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি। আহত প্রশিক্ষার্থী হর্ষিতা সিং বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে জানা গেছে।