অনলাইন ডেস্ক : তিনি এসেছেন, খেলেছেন। আবার হৃদয়ও জয় করেছেন। শিলচরের খেলাধূলার পীঠস্থানে সন্তোষ মোহন দেব যেন চিরন্তন। নানান রাজনৈতিক রেশরেশি, উতাল পাতালের পর অবশেষে স্টেডিয়ামের শাশ্বত মানচিত্রে অমর হয়ে গেলেন একনামে যার পরিচয় সেই ‘ রানা দা ‘। আবক্ষ মূর্তি বসানোর মাধ্যমে শিলচরের খেলাধুলার প্রতি তাঁর টান, অক্লান্ত পরিশ্রমকে স্বীকৃতি দিল জেলা ক্রীড়া সংস্থা। বিভিন্ন বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে জাতীয় ফুটবলের প্রাক্তন অধিনায়ক তথা প্রখ্যাত গোলরক্ষক ভাস্কর গাঙ্গুলীর হাত দিয়ে উন্মোচন হল স্টেডিয়ামের প্রাণপুরুষ সন্তোষ মোহন দেবের মূর্তি।
শুক্রবার ছিল জেলা ক্রীড়া সংস্থার ৬৭ তম প্রতিষ্ঠা দিবস। সেজন্য সন্তোষ মোহনের মূর্তি উন্মোচনের জন্য এই বিশেষ দিনটাকেই বাছাই করে নিয়েছেন বাদশা, বাবুল হোড়রা। এই মাঠটার প্রত্যেক কণা কণার সঙ্গে অন্তরের পরিচিতি ছিল সন্তোষ মোহন দেবের। বাপ্ দাদাদের সঙ্গে মাঠে এসে খেলা দেখা থেকে শুরু করে খেলাধুলা, রেফারিং – যেন সন্তোষই সন্তোষ। খেলাধুলার পাট চুকিয়ে রাজনীতির রণাঙ্গনে পা দিয়ে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেও প্রথম প্রেমকে কখনই মন থেকে তাড়াতে পারেননি সন্তোষমোহন। শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থার ডাককে কখনও না দেখা করতে পারেননি ‘রানা দা ‘। সময়ে সময়ে সাহায্যের ডালি নিয়ে হাজির হয়েছেন। ভিত্তিপ্রস্তর থেকে শুরু করে আজকের এস এম স্টেডিয়াম, চিৎকার করে বলছিলো সন্তোষ মোহনের অবদানের কথা। বলা বাহুল্য এই এস এম দেব স্টেডিয়ামই সন্তোষ মোহনের কর্মজীবনের কৃতিত্বের অন্যতম সাক্ষী বহন করে চলেছে। এতসবের পরও নানান টালাবাহানা, কোভিড, কংগ্রেস – বিজেপি, পরবর্তীতে তৃণমূল (!) রাজনীতি। তারিখ পে তারিখ । আর পিছোতে থেকে মূর্তি উন্মোচন প্রক্রিয়া। অবশেষে জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রতিষ্ঠা দিবসের মাহেন্দ্রক্ষনে আলো বাতাসের খোঁজ পায় সন্তোষ মোহনের মূর্তিটা।
বিজেন্দ্র প্রসাদ সিং, বাবুল হোড় নেতৃত্বাধীন কমিটি আনুষ্ঠানিকতায় নূন্যতম কার্পণ্যও করেনি। শহরের বিশিষ্টজন, আজীবন সদস্যদের পাশাপাশি বরাকের বাকি দু-জেলা তদুপুরি গুয়াহাটির ব্যক্তিবর্গরাও ছিলেন অতিথি তালিকায়। সকালে সংস্থার পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ডিএসএ -র প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানের সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর দুপুরের দিকে ভাস্কর গাঙ্গুলির হাত ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচিত হয় সন্তোষ মোহন দেবের আবক্ষ মূর্তির। উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিতদের ‘ সন্তোষ মোহন জিন্দাবাদ ‘, ‘ রানা দা অমর রহে ‘ ধ্বনি – প্রতিধ্বনিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠে ডিএসএ -র। নিজের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রধান অতিথি ভাস্কর গাঙ্গুলি বলেন,’ সন্তোষ মোহন দেব শিলচরের বাসিন্দা হলেও উনার পরিচিতির পরিধিটা বেশ বিস্তৃত। তাঁকে বহুমুখী প্রতিভা বললেও ভুল হবে না। ক্রিকেট থেকে ফুটবল, টেনিস খেলোয়াড়- এরকম বহুমুখী প্রতিভার সন্ধান পাওয়া দুস্কর। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি গোটা দেশেই সন্তোষবাবুর অবদানের সাক্ষ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অতীতে বরাক থেকে অনেক ফুটবলারই কলকাতার মাঠ কাঁপাতেন। কিন্তু এখন বরাকের পাশ্ববর্তী মনিপুর এবং মিজোরামের ফুটবলাররা জাতীয় স্তরে শাসন করছে। যদি বরাকের ফুটবলে পুরোনো দিন ফিরে আসে তাহলে মনে করবো সন্তোষ মোহন দেবের আত্মা শান্তি পেয়েছে।’ প্রতিষ্ঠা দিবসে সন্তোষ মোহন দেব সহ শিলচরের ৩২ জন প্রাক্তন খেলোয়াড়কে নিয়ে একটি স্মরণিকা বের করা হয়। উপস্থিত অতিথিদের হাত ধরেই তা প্রকাশ হয়। অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সন্তোষ মোহন দেবের কন্যা তথা রাজ্যসভার সাংসদ সুস্মিতা দেব। বাবার মূর্তি বসানোর জন্য শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সুস্মিতা বলেন,’ ছোটবেলায় বাবার হাত ধরেই ডিএসএ মাঠে আসতাম। পরবর্তীতে একদিন উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ডিএসএ নিয়ে আপনি এত ব্যস্ত থাকেন কেন? তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন খেলাধুলা আমার প্রথম ভালোবাসা। আজ বুঝতে পারছি কেন তিনি এই কথাটা বলেছিলেন। তাই বলছি শিলচরের খেলাধুলার উন্নতির স্বার্থে রাজনীতির ডুয়েল ভুলে সবাইকে একযোগে কাজ করা উচিত। ‘
শুক্রবারের মূর্তি উন্মোচন অনুষ্ঠানে সন্তোষ মোহন দেব ছিলেন বিরোধহীন এক ব্যক্তিত্ব। শিলচরের সাংসদ তথা সন্তোষ মোহন দেবের একসময়ের রাজনীতির প্রতিপক্ষ প্রয়াত বিমলাঙশু রায়ের ছেলে ড. রাজদীপ রায় বলেন, ‘ এখানে অনেক প্রাক্তন খেলোয়াড়দের দেখতে পাচ্ছি যাদের খেলা দেখতে মাঠে আসতাম। ভালো লাগছে রাজনীতির উর্ধ্বে ওঠে ক্রীড়া উন্নয়নে সবাই এগিয়ে এসেছে । সন্তোসমোহন দেবের প্রথম পরিচয় খেলোয়াড়, এরপর রাজনীতিবিদ। ১৯৮০ -র আগে তিনি একজন আপাদমস্তক খেলোয়াড়। জিতেন্দ্র চন্দ্র দাসগুপ্ত কে সঙ্গে নিয়ে টেনিসে রাজ্যসেরাও হয়েছেন। ১৯৬৮ সালে গুয়াহাটিতে বার্মা – ম্যাচের রেফারি ছিলেন। ৮০-র পর হন ক্রীড়া সংগঠক। শুধু ফুটবল নয় ক্রিকেটের উন্নয়নেও এগিয়ে এসেছিলেন। জেলা তথা রাজ্যে এসএম দেবের অবদান অনন্য। স্থানীয় খেলোয়ারদের সুবিধা দিতে পিএম-র নির্দেশে দুবার হয়েছে এমপি কাপ। ডিএসএ-র পরিকাঠামো উন্নয়নে মুখ্যমন্ত্রী ১০ কোটি ঘোষণা করেছেন। এরমধ্যে ৫ কোটি রিলিজ হয়েছে। ৫ কোটির কাজ হলে আরও ৫ কোটি আসবে।’ শিলচরের বিধায়ক দীপায়ন চক্রবর্তী বলেন,’ আমাদের সবাইকে সন্তোষ মোহন দেবের পূর্ণাঙ্গ স্টেডিয়াম নির্মাণের স্বপ্ন সার্থক করতে হবে। কেউ যদি ৫০ বিঘা জমির হদিশ দিতে পারে তাহলে ৫০ কোটি ব্যয়ে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মাণ সম্ভব। কারণ শহরের মধ্যে স্টেডিয়াম হলে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে।’
বিশিষ্টজনের মধ্যে অন্যান্যদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক জয়দীপ বিশ্বাস, বিশিষ্ট কবি – সাংবাদিক অতীন দাশ প্রমুখ। নিজের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জয়দীপ বিশ্বাস বলেন,’ খেলাধুলা নিয়ে আমার এক নস্টালজিকতা রয়েছে। কারণ পত্রিকা খুললেই আমি প্রথমে শেষের পাতা উল্টে দেখি। আমাদের কাছে খেলোয়াড়রা এক একজন হিরো। প্রবাদপ্রতিম সন্তোষমোহন দেব পিছনের পাতা থেকে সামনের পাতায় উঠে এসেছেন। রাজনীতির পাশাপাশি ক্রীড়াসংগটক সন্তোষমোহনকেও সবাই ভালোবাসত। সঙ্গে এটাও বলছি, সরকারের কিছু অনীহা খেলাধুলার উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। কেন্দ্র বলুন বা রাজ্য সরকার, বাজেটে খেলাধুলাকে অনেকটাই খাটো করে দেখা হচ্ছে। ক্রীড়াক্ষেত্রে বরাদ্দটা অনেকটাই কম বলতে হয়। খেলোয়াড় পিছু ২৪ টাকার কাছাকাছি হবে। এরকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোলে অলিম্পিকের মত মেগা আসরে অতিমাত্রায় সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়। ‘ অতীন দাশ বলেন,’ খেলাধুলা নিয়ে কিছু বলব না। বরাকের প্রশ্নে একজন বড় মাপের মানুষ হিসেবে পরিচিত সন্তোষমোহন দেব। নেতাজি, স্বামীজির মতই সেজন্য সন্তোষমোহন দেবেরও মূর্তি প্রতিস্থাপিত করা হল।’
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন সভাপতি বাবুল হোড়, ডিএসএ -র আজীবন সদস্য তথা দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গের সম্পাদক তৈমুর রাজা চৌধুরী, বাদল দে, প্রাক্তন রঞ্জি ক্রিকেটার করণ দুবে, বড়খলার বিধায়ক মিসবাহুল ইসলাম লস্কর, উপসভাপতি ড. সিদ্ধার্থ শঙ্কর ভট্টাচাৰ্য, সুজন দত্ত, জেলাশাসক রোহন কুমার ঝা, একাডেমির সভাপতি শিবব্রত দত্ত, আশুতোষ রায়, হেমরঞ্জন রায়, চন্দন শর্মা, সুমন্ত সারতী এন্দ,। অনুষ্ঠানের শেষপর্বে সংবর্ধনা জানানো হয় সমর নাথ, দিলীপরঞ্জন নন্দী, জহর গুপ্ত, জহর পাল, হিমেন্দু সেনগুপ্ত, কৃষ্ণবাহাদুর ছেত্রী, বিশ্বজিৎ ধর, বদরুদ্দিন মজুমদার, পঙ্কজ পুরোকায়স্ত, নিহার পুরোকায়স্ত, স্বদেশ বিশ্বাস, সুবল শীলকে।