অনলাইন ডেস্ক : শ্রীলংকা দেখলাম। আর এখন বাংলাদেশ। মুহূর্তেই সুন্দর, স্নিগ্ধ,নীলাভ ঠিকানাগুলি পদদলিত হয়ে গেল অচিনপুরের বিধ্বস্ত ধ্বংসাবশেষে। রাজার নাকি রাজাকারের জয় হল, উপসংহারে অবশ্য ‘ সংহার ‘ হয়ে গেল আস্ত একটা দেশের। গানের শিশিরে ‘ সোনার ‘ মুকুল আবার কবে প্রস্ফুটিত হবে, কে জানে!!
‘ আমার সোনায় বাংলা ‘- বাংলাদেশের প্রোফাইলটা কিন্তু এরকমই। তবে সাম্প্রতিক তথাকথিত বিপ্লবের সুনামিতে আজ সোনার প্রলেপটা ফিকে হয়ে ধ্বংসবশেষে পরিণত বাঙালির ‘ আপন ‘ বলা দেশটা। কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্যাসে হাসিনা দেশ ছাড়লেও হানাহানির ক্ষত দেশটাকে অনেকটাই পিছিয়ে দিল বটে। যুগে যুগে এই ‘ বিপ্লবের ‘ সাক্ষী থেকেছে মানব সভ্যতা। কেউ বা শান্তিপূর্ণভাবে তো কোনো বিপ্লব স্বাদ নিয়েছে রক্তের। জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী থেকে লেনিন – অনেক মনীষীই বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিপ্লবের। বাংলাদেশের সদ্য জাগ্রত বিপ্লবটা অন্যদিকেই পা রেখেছিলো। প্রতিবেশী ভারতের মুন্ডপাত আর সেইসঙ্গে মৌলবাদের দুর্ঘন্ধ – ছাত্রদের মুখোশে প্রতিবাদের কুৎসিত রূপটাই দেখেছে ওপার বাংলা। হাসিনার দেশত্যাগের পরই বাংলাদেশের যে সব ধ্বংসাত্মক ছবি দেখল সারা বিশ্ব, তা গভীর উদ্বেগের। রাজনৈতিক অস্থিরতার পথ ধরে যদি মৌলবাদী ইসলামের প্রভাব সে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তা হবে অতি বিপজ্জনক। বাস্তবিক, ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘুদের প্রাণ ও সম্পদের উপর আক্রমণের কথা জানা গিয়েছে, বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক বাংলাদেশি নেতা-শিল্পী-চিন্তকদের প্রতি জনতার ক্রোধ ধাবিত হতে দেখা গিয়েছে, শেখ মুজিবের মূর্তি নির্মম ভাবে ভাঙা হয়েছে। যত ক্ষণ পর্যন্ত না এই আক্রমণ ও বিদ্বেষকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে, তত ক্ষণ ও দেশের নতুন পালাবদলের প্রকৃত চরিত্র বোঝা যাবে না। এমনিতেই গত মাসাধিক কাল ধরে বাংলাদেশে যা ঘটছে, সেই ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপহীন। বহু শত প্রাণ বিনষ্ট। বিশেষ যন্ত্রণার বিষয়— অধিকাংশ নিহতই তরুণ, এমনকি কিশোর। সরকারি সংরক্ষণ নীতিকে কেন্দ্র করে ছাত্র আন্দোলনে প্রশাসনের নির্মম গুলিচালনা ও ছাত্রছাত্রী-সহ অন্যান্যের প্রাণহানি— এই ভয়াবহ ঘটনা থেকে শুরু করে সে দেশে বিক্ষোভ-প্লাবন ঐতিহাসিক আকার নিল। মনে রাখা ভাল, এই সঙ্কট কোনও একটিমাত্র ঘটনার ফল নয়, হতে পারে না।
অতীত সাক্ষী থেকেছে অনেক ছাত্ররা অনেক বড় বড় দেশের নকশা পাল্টে দিয়েছেন। ফলে বাংলার এই আন্দোলনকে নিয়ে অভিযোগের কিছু নেই। আর বাংলাদেশিদের রক্তেই রয়েছে লড়াই। একাত্তরের স্বাধীনতার বিপ্লব এখনও অনেকের রক্তের হিমোগ্লোবিনে তাজা। কিন্তু তথাকথিত আজকের সব ব্লগাররা মনে গুগল সার্চ করতে ভুলে গেছেন। নইলে চিৎকার করে করে ‘ ইন্ডিয়া গো ব্যাক ‘ মার্কা কোনো স্লোগান তুলতেন না। সেদিন পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে বাংলাদেশিদের চিরতরে মুক্তি দিয়েছিল ইন্দিরার সেনা। আর এই মুক্তির লড়াইয়ের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ সেই লোকটারই মূর্তি, ছবি পদদলিত হচ্ছে বাংলাদেশিদের পায়ের তলায়। অন্যের দেশ তাই মস্তিস্ক বলছে ওদের নেতা ওদেশ, যাক না সব চুলোয়। কিন্তু বাঙালি হিসেবে মুজিবের মূর্তি ভাঙ্গার ঘটনায় সত্যিই লজ্জায় মুখ ঢেকে যাচ্ছে।
ভুলত্রুটি প্রত্যেক শাসনেই থাকে। হাসিনারও ছিল। দুর্নীতি, স্বজন পোষণ, অত্যাচার এসবের অভিযোগের মুকুলেই হাসিনা বিরোধী বটবৃক্ষের উৎপত্তি। এই বিদ্রোহ দমাতে যা কিছু প্রয়োজন করেছেন হাসিনা। সাম দাম দন্ড ভেদে পুলিশের হাত দিয়ে গুলি ছুঁড়েছেন। দোষী (!) নির্দোষ অনেকেই মারা পড়ল। হাসিনা যখন আর পারলেন না পালালেন ‘ নিজের বাপের বাড়ি ‘ ছেড়ে। আর ছাত্ররা করল কি ? চুরি লুটের পাশাপাশি নিজের মাতৃসম এক মহিলার অন্তর্বাস নিয়ে আদিম উন্মাদনায় মেতে উঠছিলো। এরা কি ছাত্র ? ‘ ছি ‘ শব্দটাও এক্ষেত্রে কম পড়ে যায়। এদের হাতেই বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়োজিত!! আপাতত ইউনিস সাহেবদের ‘ বেস্ট অফ লাক ‘ বলা ছাড়া কোনো উপায় নেই!!!! বঙ্গভবনের ফুটেজগুলি পুরো আন্দোলনের উদ্দেশ্যে দু বালতি জল ঢেলে দিল বৈকি। থানায় ঢুকে পুলিশ কর্মীদের হত্যা, মুক্তমনা ব্লগার, সাংবাদিক খুন। নিথর দেহকে প্রকাশ্য মঞ্চে ঝুলিয়ে রাখা !!!! সভ্য দেশের সমাবেশে এমনটা কি সম্ভব। প্রশ্ন আর উত্তর দুটোই তুলে রাখা থাকল।
আন্দোলনের শেষপর্বে ছিল সে দেশের সফট টার্গেট সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের উপর আক্রমণ। হিন্দু সহ সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের সত্য মিথ্যায় অনেকগুলি ফুটেজই নেটদুনিয়ায় আবির্ভাব হয়েছে। আত্মসমালোচনার সুরেই বলছি সব ফুটেজ তো আর মিথ্যে নয়। অনেক গোপন সূত্রই দাবি করেছে এই হানাহানির নেপথ্যে কাজ করেছে পাক মৌলবাদ। একাত্তরের বিতরণের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানের প্রচেষ্টার কোনোকালেই খামতি ছিল না। অনেকবারই হয়েছে। এবারও তাই বুঝি। বাংলাদেশে এই একমাসের দ্রোহকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং আতঙ্কিত হিন্দুরা। তাদের উপর শুরু হয়েছে প্রতিহিংসার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি! কিন্তু কেন এই বিদ্বেষ তাদের উপর? একটাই জবাব হতে পারে, পাকপন্থীদের দৃঢ়মূল সন্দেহ, হিন্দুরা হাসিনার সমর্থক। কিন্তু নিছক সন্দেহের বশে কাউকে চরম সাজা দেওয়া যায় কি? বহু দলীয় গণতন্ত্রে কোনও স্বীকৃত পার্টির প্রতি নীরব সমর্থন কি অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে? তাহলে সেই সমাজকে ‘সভ্য’ বলে ধরা হবে কোন বিচারে? সেনা প্রধান এবং দায়িত্বশীল দলগুলি ও সমাজের মাথাদের এই নিন্দনীয় নীরবতা, নিষ্ক্রিয়তা দেশে একটি নির্বাচিত সরকারের অনুপস্থিতিরই প্রমাণ দিচ্ছে। একমাত্র প্রকৃত গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিই বাংলাদেশকে এই নৈরাজ্য থেকে দ্রুত মুক্তি দিতে পারে। এ দেশের হিন্দু সংগঠনগুলি এই নির্যাতনের প্রতিকারের আর্তি জানাচ্ছে। কিন্তু আমার দেশের সরকার মনিপুর নিয়েই কোনো বিবৃতি দেয়নি। আর বাংলাদেশ তো প্রতিবেশী রাষ্ট্র।
এদিকে বাংলাদেশের এই অগ্নিগর্ভ অবস্থা আরও কিছু কারণে ভারতের জন্য চিন্তার কারণ। প্রথমত প্রতিবেশী রাষ্ট্রে মৌলবাদের উত্থানে আমাদের দেশে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ। দ্বিতীয়ত, আমেরিকা যা চেয়েছিল, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় পুনরায় নিজেদের দাদাগিরি পুনরায় স্থাপিত করতে চলেছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পাকিস্তান – চিনের যে অসাধু চক্র প্রায় ঘিরে ফেলেছে ভারতকে। মালদ্বীপ, নেপাল বলুন বা শ্রীলংকা, সবশেষে বাংলাদেশ – আমাদের ভালো প্রতিবেশী বলে আর কেউই থাকল না??
এতসব হিংসাত্মক পরিণতির পর পূর্বপুরুষদের দেশে একটা সরকার তো বসলো। এখন সেখানে হানাহানি কমে একটা স্থিরতা আসবে। আর পুনরায় সোনার প্রলেপে ঢাকা পড়বে বাংলা। চাওয়া পাওয়া তো এতটুকুই।
বিশেষ নিবন্ধ শুভেন্দু দাশ