উত্তমকুমার সী
শিলচর, ২৬ এপ্রিল : কাছাড়ের জেলাশাসক কার্যালয়ে অনিয়মই কার্যত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে! জেলার সর্বময় কর্তাকে অন্ধকারে রেখে একাংশ কর্মী এককালে গড়ে তুলেছিলেন ‘বাবু সিন্ডিকেট’! আজ সেটা ফুলে-ফলে-পাতায় এবং গাড়ি-গরুতে ঢেকে এমন গভীরে লুকিয়েছে যে প্রশাসনের কাছে তার শেকড় বের করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। ওই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই বিগত ৩০/৩৫ বছর ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে শিলচর সার্কিট হাউসের ক্যান্টিন। ফলে এর ভেতরে তৈরি হয়েছে অনিয়মের পাহাড়। সম্প্রতি জেলাশাসক রোহন কুমার ঝা-র নজরে এমন এক অনিয়ম ধরা পড়ায় কড়া নির্দেশে সার্কিট হাউস এবং ডিসির বাংলোয় ক্যাটারিং কন্ট্রাক্টর হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত পিনাক চক্রবর্তীকে ‘ব্ল্যাকলিস্টেড’ করেছেন।
জেলাশাসক এই মর্মে এক নির্দেশ জারি করে ২০১১ সালের খাদ্য সুরক্ষা সংক্রান্ত এফএসএস রেগুলেশন অ্যাক্ট ভঙ্গের দায়ে আসাম পিডব্লিউডি বিল্ডিং-এর ক্লাস ওয়ান (এ) রেজিস্টার্ড কন্ট্রাক্টর এবং সাপ্লায়ার মেসার্স পিনাক চক্রবর্তীকে সরকারি যে কোনও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। জানা গেছে, শিলচর সার্কিট হাউস এবং ডিসির বাংলোয় ক্যাটারিঙের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় পিনাক চক্রবর্তীর খাদ্য সরবরাহের মান বেশ কয়েকবার অবনমন হওয়ায় জেলা প্রশাসন থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু এই নোটিশের জবাব জেলা প্রশাসন এবং ওই কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী হয়নি বলে জেলাশাসকের আদেশে বলা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন সন্তুষ্ট না হওয়ায় এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সরকারি সব বিভাগে এই আদেশের প্রতিলিপি পাঠানো হয় বলেও নির্দেশে উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার সুপারিশ এবং চাপেই নাকি পিনাক চক্রবর্তীকে একদা নিয়ম বহির্ভূতভাবে সার্কিট হাউসের ক্যান্টিনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। করোনা অতিমারির শেষ নাগাদ ২০২১ সালের ৩১ মে জেলাশাসকের নাজারত শাখার এক নির্দেশে (নং-সিএনজেড ১৮/২০২০/২৯) আসলে ‘ইভেন্ট গুরু’ নামের ভেন্ডরকে সার্কিট হাউসের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিক পরদিন অর্থাৎ ২০২১ সালের ১ জুন একই নির্দেশের রেফারেন্স দেখিয়ে পিনাক চক্রবর্তী নামে পূর্ত বিভাগের জনৈক ঠিকাদার এই ক্যান্টিনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেটা কিভাবে সম্ভব হল, জেলাশাসকের কার্যালয়ে খোঁজ নিয়েও তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে ঠিকাদার মহল থেকে জানা গেছে, পিনাক চক্রবর্তীর দুটি জিএসটি রেজিস্ট্রেশন থাকলেও খাদ্য তৈরি ও সরবরাহের অধিকার তাঁর কাছে ছিল না। এহেন ব্যক্তিকে সার্কিট হাউসের ক্যান্টিন এবং ডিসি বাংলোর রান্নাঘরের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেই ‘বাবু সিন্ডিকেটে’র মাধ্যমেই। অবশ্য তাতে নাকি সায় ছিল তৎকালীন জেলাশাসক কীর্তি জাল্লিরও। বর্তমান জেলাশাসকের সামনে সেই অনিয়ম ধরা পড়ায় এবং খাদ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় পিনাক চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই অনিয়মের মূল কান্ডারি অর্থাৎ ‘বাবু সিণ্ডিকেট’ এ যাত্রাতেও রেহাই পেয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আসলে সার্কিট হাউসের ক্যান্টিনকে ঘিরে দু-একজন বাবুর মৌরসিপাট্টা বহুকাল ধরেই চলছে। এখানে কাজ করেই কয়েকজন কর্মী যথেষ্ট বিত্তশালী হয়েছেন। গাড়ি-বাড়ি-গরুর মালিক হয়েছেন। অতীতে সার্কিট হাউস পরিচালিত হত জেলাশাসকের কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মীর মাধ্যমে। যেখানে একজন ‘বাবু’ থাকতেন মূল দায়িত্বে। দীর্ঘ বছর এই পদ্ধতিতে চলার পর সেখানকার অনিয়ম প্রথম ধরা পড়ে এস লক্ষ্মণন জেলাশাসক থাকাকালীন। ২০১৮ সালে তিনিই প্রথম টেন্ডার ডেকে যোগ্য ব্যক্তিকে সার্কিট হাউসের ক্যান্টিনের বরাত দেওয়ার নিয়ম চালু করেন। প্রথম বরাত পান অর্ণব চক্রবর্তী। সেই থেকে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বরাত দিয়ে সার্কিট হাউস পরিচালনায় স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হলেও একাংশ ‘বাবু’ সেখানেও ভাগ বসান। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ক্যাটারারের কাছ থেকে ভাড়া আদায়েরও চেষ্টা করা হয়নি তখন। ২০১৯ সালে জেলাশাসক লায়া মাদ্দুরির সময় ওই ক্যান্টিনের বরাত পান অংশুমান ভট্টাচার্য। তখনই প্রথম ক্যান্টিন এবং বাসনপত্রের ভাড়া হিসেবে মাসিক ১০ হাজার টাকা ধার্য করা হয়। সে অনুযায়ী এক বছরে অংশুমানের কাছ থেকে ভাড়া হিসেবে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে। এটাই ছিল সার্কিট হাউস ক্যান্টিন বাবত সরকারের প্রথম রাজস্ব আদায়। করোনা অতিমারির সময় শিলচরের সিংহভাগ সরকারি খাদ্যের যোগান দিয়েছিল সার্কিট হাউসের ওই ক্যান্টিন। চুক্তি অনুযায়ী সময়সীমা শেষ হলেও করোনা অতিমারির জন্য অংশুমানকে আরও তিন মাস ক্যান্টিন চালাতে বলা হয়। কিন্তু তখন নয়া জেলাশাসক হিসেবে কীর্তি জাল্লি এসেই টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করে দেন। সেইসঙ্গে অংশুমানকে ক্যান্টিন ছেড়ে দিতে চাপ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু বকেয়া পাওনা না মেটানোয় অংশুমান তখন গৌহাটি হাইকোর্টে জেলাশাসকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। অন্যদিকে ঠিকাদার পিনাক চক্রবর্তীকে সার্কিট হাউসের দায়িত্ব হস্তান্তরের জন্য ‘বাবু সিণ্ডিকেট’ তোড়জোড় শুরু করে। নিয়ম নীতিকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবশেষে ২০২১ সালের ১ জুন পিনাককে ক্যান্টিনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যদিও সরকারি নথিতে সেই দায়িত্ব পায় ‘ইভেন্ট গুরু’ নামের সংস্থা। আর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বাবু সিন্ডিকেটের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন অংশুমান ভট্টাচার্য। পরে আদালতের চূড়ান্ত রায়ও তাঁর বিপক্ষেই যায়।
২০২১ সালে ‘বাবু সিন্ডিকেটে’র অনিয়মের খেসারত আজ দিলেন ঠিকাদার পিনাক চক্রবর্তী। আর তাদের সন্তুষ্ট করে ‘গুডবুকে’ না থাকায় পুরনো ভেন্ডররা আজও বকেয়া পাওনা আদায়ের জন্য জেলাশাসকের কার্যালয়ে হন্যে হয়ে ঘুরছেন। কিন্তু সেই ‘বাবু’রা বহাল তবিয়তে তাদের সাম্রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। এবার সার্কিট হাউসের ক্যান্টিনের অনিয়ম সামনে আসার পর জেলাশাসক গোটা ব্যবস্থার নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করলে অনেকের মুখোশ খসে পড়তে পারে। চিরতরে ভেঙে যেতে পারে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সেই ‘বাবু সিণ্ডিকেট’ও। কাছাড়ের জেলা প্রশাসনে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর জেলাশাসক রোহন কুমার ঝা এমন পদক্ষেপ করবেন বলে অনেকেই আশা প্রকাশ করেছেন।