অনলাইন ডেস্ক : ওকে মনেপ্রানে ভালোবেসেছিলাম। স্বপ্ন দেখেছিলাম ঘর বাঁধার। আর শেষ পর্যন্ত কিনা আমার হাতেই খুন হতে হলো তাকে। আসলে আমার নিখাদ প্রেমের এই প্রতিদান দেবে ও, খেলা করবে আমায় নিয়ে ,তা ভাবতে পারিনি স্বপ্নেও । তাই শেষপর্যন্ত আর সামলে রাখতে পারিনি নিজেকে।”– প্রথমত সবকিছু অস্বীকার করলেও পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের চাপে ভেঙ্গে পড়ে এক সময় ডুকরে কেঁদে উঠে এভাবেই সবকিছু উগরে দেয় পিঙ্কির প্রেমিক পিনাক শুক্লবৈদ্য।
পিঙ্কি হত্যাকান্ডের মূল অভিযুক্ত পিনাক যে শুধু এমন আবেগিক ফিল্মি ঢংয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে তা নয়, আসলে গোটা ঘটনাটাই যেন কোনও সুনিপুণ চিত্রনাট্যকারের রচিত “প্রেম-প্রতিশোধ” মার্কা থ্রিলারের এক জমজমাট চিত্রনাট্য। গত মঙ্গলবার শিলচর হাইলাকান্দি রোড মদনমোহন পার্কের বাসিন্দা বছর ১৯-এর পিঙ্কি রায় নামে যুবতীর মৃতদেহ উদ্ধার হয় ধোয়ারবন্দে এক নির্মীয়মান ত্রিতল ভবন থেকে। নৃশংস হত্যাকান্ডকে ঘিরে ওইদিন উত্তাল হয়ে উঠে শহর। এই ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ বুধবার আটক করে তার প্রেমিক হাইলাকান্দি জেলার লালা আব্দুল্লাপুর প্রথম খন্ডের বাসিন্দা পিনাক শুক্লবৈদ্য ( ২১ )কে। পিনাক বাঙ্গালুরুতে আইটিসি নামে কোম্পানিতে “রিসিপশনিষ্ট” হিসেবে কর্মরত। তাকে ঘিরে পিংকির পরিবারের লোকেরা শুরু থেকেই সন্দেহ ব্যক্ত করছিলেন। এর সূত্র ধরে বুধবার তাকে তার বাড়ি থেকে ধরে আনে পুলিশ।
এরপর তাকে জোর জিজ্ঞাসাবাদ চালানো হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা এক পুলিশ অধিকারিক জানিয়েছেন, প্রথমত সে নানা কথা বলে হত্যার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই বলে প্রতিপন্ন করতে বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলতে থাকে। তবে শেষ পর্যন্ত একসময় বিভ্রান্তিকর কথার জালে তার সৃষ্টি করা প্রতিরোধের বাঁধ ভেঙ্গে পড়ে। এবং ঠুকরে কেঁদে উঠে, কবুল করে হত্যার কথা। এই ঘটনা নিয়ে বৃহস্পতিবার এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে পুলিশ সুপার নূমল মাহাতো জানান, হত্যার পেছনে রয়েছে ত্রিকোণ প্রেমকে ঘিরে দ্বন্দ্ব। এর জেরে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে পিনাক প্রেমিকা পিংকিকে হত্যা করেছে ।
পুলিশ সুপার জানান, ফেসবুক মারফত বেশ কিছুদিন আগে দুজনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল প্রেমের সম্পর্ক। এরপর যথারীতি তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, এতে আরও গাঢ় হয়েছে সম্পর্ক। এসবের মাঝেই কিছুদিন ধরে পিনাকের মনে সন্দেহ জেগে উঠে পিঙ্কি, অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক জড়িয়েছেন। এ নিয়ে দুজনের মধুর সম্পর্কের মাঝে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্বের।
সম্পর্কে দ্বন্দ্বের মাঝেই গত ১৩ জুলাই বাঙ্গালুরু থেকে শিলচরে আসে পিনাক। শিলচরে আসলেও সে তার লালার বাড়িতে যায়নি। শিলচরেই থেকে যোগাযোগ করে পিঙ্কির সঙ্গে। এরপর ১৫ জুলাই শনিবার রাতে পিংকি তার কর্মস্থল শহরের প্রেমতলা এলাকার কাপড়ের দোকান “বুনকর “থেকে বেরিয়ে শ্শশান রোডে মালিকের বাড়িতে চাবি দেওয়ার পর মিলিত হন পিনাকের সঙ্গে। এর কিছুক্ষণ পরই ঘটে যায় সেই হত্যাকাণ্ড।
পুলিশ সুপার জানান, ঘটনা নিয়ে পিনাক যে বয়ান দিয়েছে সে অনুযায়ী-শনিবার রাতে তারা মিলিত হবার পর প্রেমতলা থেকে ৫০০ টাকায় অটো ভাড়া করে পিনাক। অটোয় চড়ে ধোয়ারবন্দে যাওয়ার পর তারা নিভৃতে কথাবার্তা বলতে নির্মীয়মান বহুতল ভবনের উপরে যায়। সেখানে সে অন্য যুবকের সঙ্গে পিঙ্কির সম্পর্কে জড়ানোর প্রসঙ্গ উঠিয়ে পিনাক জবাবদিহি করলে দুজনের মধ্যে শুরু হয় তুমুল বিবাদ। রাগের মাথায় একসময় সে পিঙ্কির গলা টিপে ধরে। এতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পিঙ্কি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই অবস্থায় সে রাতে থেকে যায় সেখানেই। সেখানে বসে বসে নিজেকে বাঁচানোর জন্য চিন্তা করতে করতে ঠিক করে, চলে যাবে গুয়াহাটিতে। যেহেতু সে যে শিলচরে এসেছে তা তার নিজের বাড়ি বা পিঙ্কির বাড়ির লোকেরা জানতেন না, তাই তার ধারণা হয় গুয়াহাটিতে গিয়ে সেখানে থাকার প্রমান জোগাড় করতে পারলেই বেঁচে যাবে সে। প্রমাণ হয়ে যাবে ঘটনার সময় সে শিলচরেই ছিল না । এই ভাবনা থেকে রাতে ধোয়ারবন্দের নির্মীয়মান ভবনে কাটিয়ে ভোরের দিকে চলে যায় রামনগর আইএসবিটিতে। সেখান থেকে চলে যায় গুয়াহাটিতে। পরবর্তীতে গুয়াহাটি থেকে ফিরে এসে চলে যায় লালায় নিজের বাড়িতে।
পিনাকের এমন বয়ানের কথা তুলে ধরে পুলিশ সুপার বলেন, সে যে হত্যাকারী এরপর আর এ নিয়ে কোনও সংশয় থাকার কথা নয়। তবে স্রেফ তৎক্ষানিক উত্তেজনার বশে ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলেছে বলে যে বয়ান দিয়েছে এ নিয়ে সংশয় থেকে গেছে অবশ্যই। হয়তো বাঙ্গালুরু থেকেই পিঙ্কিকে হত্যার সম্পূর্ণ পরিকল্পনা তৈরি করেই শিলচরে এসেছিল, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না মোটেই। এনিয়ে পুলিশ সুপারের বক্তব্য, একে তো বাঙ্গালুরু থেকে শিলচরে আসার পর সে নিজের বাড়ি বা পিংকির বাড়ির কাউকেই এ নিয়ে জানায়নি। তার আগমন নিয়ে সবাইকে অন্ধকারে রেখেছিল। এছাড়া তাকে পাকড়াও করার পর প্রথমত ১৭ জুলাই সোমবারের একটি বিমানের টিকিট দেখিয়ে দাবি করেছিল সে এসেছে ১৫ জুলাই শনিবার পিংকি নাপাত্তা হওয়ার দুদিন পর। কোনও কারণ ছাড়া নিশ্চয়ই সে অনর্থক অর্থ খরচ করে ১৭ জুলাইর বিমানের টিকিট কাটতো না। সব মিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছে হয়তো সে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা তৈরি করেই এসেছিল শিলচরে।
পুলিশ সুপার আরও জানান, পিনাক যে খুনি তা নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত এখনও কিছুটা বাকি রয়ে গেছে। এসব প্রক্রিয়া সারতে বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে পেশ করে ৫ দিনের জন্য পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ চালানো হচ্ছে।
এদিকে এই ঘটনায় ইতিমধ্যে পুলিশ আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চালালেও এখনও পর্যন্ত অন্য কারও যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানান পুলিশ সুপার। তিনি আরও জানান, পরিকল্পনা করে বা তৎক্ষানিক উত্তেজনার বশে যেভাবেই হোক পিনাক পিঙ্কিকে খুন করে থাকুক না কেন এই মুহূর্তে তারা প্রায় নিশ্চিত, ঘটনাটা ঘটিয়েছে সে একাই। মনে হচ্ছে অন্তত একথাটা সে সঠিক বলেছে । এর সূত্র ধরে তিনি আরও জানান, তদন্তের অঙ্গ হিসেবে তারা বাঙ্গালুরুতে যারা পিনাকের সঙ্গে কাজ করেন বা তার আশেপাশে থাকেন তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করে কথা বলেছেন। সেসব সূত্রে তথ্য পাওয়া গেছে, পিনাক খুব রূঢ় প্রকৃতির লোক। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এদিন তিনি জানান, পিঙ্কির মৃতদেহ উদ্ধারের পর প্রথমত হত্যা করে এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে হলেও, ময়নাতদন্তের পর প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এ ধরনের কিছু হয়নি। কয়েকদিন পড়ে থাকার দরুন মৃতদেহ এমন বর্ণ ধারণ করেছিল যে, মনে হচ্ছিল এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে তিনি আরও জানান, হত্যার আগে পিঙ্কির উপর যৌনাচার চালানো হয়ে থাকতে পারে বলে যে সন্দেহ করা হচ্ছিল, এর স্বপক্ষেও কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে এরপরও সবকিছু নিশ্চিত হতে মৃত্যুর সময় পিঙ্কির শরীরে থাকা পোশাক সহ অন্যান্য সামগ্রী ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে আহমদাবাদের ল্যাবরেটরীতে।
এভাবে বিবরণ তুলে ধরে পুলিশ সুপার জানান, পিনাকের অপরাধের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে শীঘ্রই পুরো তদন্ত প্রক্রিয়া গুটিয়ে এনে আদালতে পেশ করা হবে চার্জশিট। যাতে করে শীঘ্রই তার বিরুদ্ধে শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া।
এদিকে পিঙ্কির বাবা নৃপেন্দ্র রায় এবং মা উমা রায়ও দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সেরে পিনাককে কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দেবার আর্জি জানিয়েছেন। সন্তানহারা মা- বাবা বলেন-তাদের মেয়ে তো গেছে, তাকে আর ফিরে পাবার উপায় নেই। এবার পিনাকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলেই শান্তি পাবে তাদের মেয়ের আত্মা।