অনলাইন ডেস্ক : কাহিনীটা আর যেই সেই নয়। লড়াই, অনুপ্রেরণার গভীরতায় হার মানাতে পারে সেলুলয়েডের কোনও ব্লকবাস্টারকেও। কল্পনা – বাস্তবের লুকোচুরির গর্ভে জন্ম এই মোনালিসার। ক্যান্সারের ভয়াবহ বলয় থেকে বেরিয়ে যে নাকি আজ স্বপ্ন দেখছে শীর্ষশৃঙ্গ জয়ের।
টিনএজের গণ্ডিটাও এখন অবধি ঠিকমত পের হতে পারেনি। নাম তার মোনালিসা কর। আক্ষরিক অর্থেই ফাইটার। সেই ছোট্টবেলায় মাকে হারানো মেয়েটাকে মাত্র পনেরোতে লড়তে হয়েছে ভয়াবহ মারণব্যাধি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে। এতসব বাধাবিপত্তির হার্ডল টপকে আজ স্বপ্নউড়ানে আগ্রহী এই মোনালিসা। জয় করতে চায় ‘ সব অহংকারের শিরোমনি ‘ হিমালয়ের মাউন্ট এভারেস্টকে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন!! শিলচরের একমাত্র মহিলা মাউন্টেনিয়ার বছর একুশের মোনালিসার আপাতত অভিলাষা – ‘ এভারেস্ট জয়।’
একে তো মেয়ে। তারউপর আবার মাউন্টেনিয়ারের মত থ্রিলিং গেম – আমাদের, আপনাদের নাক সিটকানোটাই স্বাভাবিক। তবে হার না মানা মোনালিসার গল্পটা কথায় বার্তায়, আলাপ আলোচনা, সামাজিক মাধ্যমে ট্রেন্ডিং স্ট্যাটাস পাওয়ার দাবি রাখে।
মোনালিসার জীবনে কোনোকিছুই স্ক্রিপ্টেড ছিল না। মিলন কর এবং ললিতা করের কোল আলো করে পৃথিবীতে আসা। শৈশবেই ট্রাজেডির কবলে পড়তে হয় তাঁকে। যখন প্যানকিয়ার্স ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অন্য লোকে পাড়ি দেন মোনালিসার মা ললিতা। পরে মোনালিসা যখন ক্লাস নাইনে পড়ছে, তার গায়েও বাসা বেঁধেছিল সেই একই মারণব্যাধি। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় এই রোগ থেকে রিকোভারি করে নেয় মোনালিসা। এই তো ছিল মেয়েটার জীবনের লড়াইর ইন্ট্রো মাত্র।
এবার পর্বতারোহি হওয়ার সফরের স্টার্টিং পয়েন্টের দিকে ফোকাস করা যাক। সেই সাত পাঁচটা দিনের মতই অলস একটা দুপুরে টিভি দেখছিলো মোনালিসা। আচমকা চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে থেমে যায় সে। একটা চ্যানেলে উত্তরকাশিতে পর্বতারোহন নিয়ে কিছু তথ্যচিত্র দেখাচ্ছিল। বেশ মনোযোগ সহকারে অনুষ্ঠানটা দেখে সে। ভালোই লেগেছিলো। ভালোলাগাটা জাস্ট ভালোলাগাতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। রূপ নেয় জেদের, পাগলামোর। স্বপ্নটাকে বাস্তবের ক্যানভাসে চিত্রায়িত করতেই হবে।
রাতে বিষয়টা মোনালিসা তার সবচেয়ে কাছের লোক অনুপ্রেরণার উৎস, বন্ধুসম বাবাকে খুলে বলে। সঙ্গে আবদার করে উত্তরকাশিতে গিয়ে হিমালয় দর্শনের। বাবাও কথা দেন পরীক্ষার ফল ভাল করলে মেয়েকে সেখানে নিয়ে যাবেন।
মেয়েকে দেওয়া কথা অনুযায়ী, সেই বছরই উত্তরকাশিতে গেলেন মিলনবাবু। সেখানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিং ( এন আই এম ) -এ গিয়ে বেশ ভালো লেগে যায় মোনালিসার। তখন পর্বতারোহি হওয়ার স্বপ্ন তার মাথায় চেপে যায়। সেই স্বপ্নকে বাস্তবের স্বীকৃতি দিতে
এন আই এমের ফর্মও নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু ভবিতব্য অন্যকিছুই লিখে রেখেছিলো মোনালিসার জন্য। আচমকা কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর মোনালিসা জানতে পারে, তার শরীরে বাসা বেঁধেছে মারণব্যাধি ক্যান্সার। তবে হার মানেনি মোনালিসা। বয়স কম থাকায় ক্যান্সার সেরে উঠে অচিরেই। চিকিৎসকরাও মানসিক শক্তির ভুয়ষী প্রশংসা করে বলেছিলেন, পর্বতারোহনের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে তার কোনো অসুবিধা হবে না।
তবে উত্তরকাশিতে এযাত্রায় আর ভর্তি হওয়া হয়নি। সেই আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে ২০২১ সালে দার্জিলিংয়ে হিমালয়ান মাউন্টেনারি স্কুলে বেসিক কোর্স -এ ভর্তি হয়ে যায় মোনালিসা। সেই শুরু। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। হোঁচট খেয়েছে, পড়েছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। গুটি গুটি পায়ে মোনালিসা চড়েছে সাফল্যের একের পর এক শিখর। দার্জিলিংয়ে সামরিক বাহিনীর কর্তাদের সান্নিধ্যে পর্বতেরোহনের ‘ অ আ ক খ ‘ টা বেশ ভালোভাবেই আয়ত্ত হয়ে যায় মোনালিসার। ১৬,৫০০ ফিট উচ্চতার কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের মাউন্ট রেনকে উঠার মাধ্যমে শৃঙ্গ চড়ার প্রথম স্বাদটা পায় মোনালিসা। সেখানে কোর্স শেষ হওয়ার পর এভারেস্ট কিংবদন্তী তেনজিং নোরগের ছেলে জেমলিন নোরগের হাত থেকে সংবর্ধনা নেন মোনালিসা। জেদ যখন মাথায় চেপেছে, তাহলে থামলে কি চলবে।
পর্বতেরোহনে আরও হাই আল্টিটুডে পৌছতে এবার দেবভূমি উত্তরাখন্ডে পাড়ি দেওয়া মোনালিসার। উত্তরাখন্ডের হিমালয় অঞ্চলকে পর্বতেরোহিরা সবচেয়ে কঠিন বলে আখ্যা দেন, এমনটাই ভাষ্য মোনালিসার। সেখানে ট্রেনিংটা আরও কঠিন হয়ে গিয়েছিলো তার। তাদের যে দলটা ছিল, সেখানে সবচেয়ে কনিষ্ঠ এবং অনভিজ্ঞ ছিল মোনালিসাই। লাদাখের একটা দলের সঙ্গে ২০ দিনের একটা থ্রী পয়েন্ট এডভেঞ্চারে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মাউন্ট সেতপন্তের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল মোনালিসা। তার কথা অনুযায়ী, একমাত্র বাবার আশীর্বাদ এবং ঈশ্বরের করুণা থাকায় তারা সেই সফর থেকে ফিরে আসতে পেরেছিল। কারণ আচমকাই সেখানকার আবহাওয়া খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বাজে আবহাওয়ার জন্য যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। একেবারে ‘ ডু ওর ডাই ‘ সিচুয়েশন। ২০ দিনের সফর গিয়ে পৌঁছে ৩০ দিনে। সঙ্গে থাকা রেশনও ফুরিয়ে এসেছিলো প্রায়। তখন দেবদুতের মত আবির্ভাব ঘটেছিল সিআরপিএফের একটা দলের। তাদের সাহায্যেই সেযাত্রায় আমাদের রক্ষে হয়েছিল বলে জানায় মোনালিসা। কারণ সেই বছরই একই অঞ্চলে ২৯ জনের একটা পর্বতারহি দলের একই জায়গায় মৃত্যু হয়েছিল। সেই দলে অসমেরও একজন ছিলেন।
আগেই তো বলেছি বাধা বিপত্তি মোনালিসাকে আটকাতে পারবে না। নিজের প্রশিক্ষণের চূড়ান্ত ধাপ পূর্ণ করতে এবার লাদাখে পাড়ি দেওয়া। সেখানে ছয় মাসের একটা ট্রেনিং পর্ব পেরোতে হয় মোনালিসাকে।দুর্গম কার্গিল এবং জানস্কা জেলায় ছিল সেই ট্রেনিং। বিশেষ করে মোনালিসার মুখে বেশি উচ্চারিত হয় জানস্কা উপত্যকার কথা। সেখানকার লোক এবং প্রকৃতির মধ্যে দূ মাস কাটানোর সুযোগ হয়েছিল মোনালিসার। এই জানস্কা শৃঙ্গ – এ সবাই উঠতে চায় না। প্রশিক্ষকদের কথা অনুযায়ী, ভাল পর্বতারহী হতে গেলে এই জানস্কা শৃঙ্গ – এ চড়তেই হয়। সঙ্গে মোনালিসার প্রশিক্ষকরা তাঁকে বলেছেন অভিজ্ঞতা বাড়াতে হলে একা চড়াইয়ে যেতে হবে। তাই জানস্কা শৃঙ্গ – এ একাই চড়েছে মোনালিসা। ফলে হাই আল্টিটিউডে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি অভিজ্ঞতাটাও বেড়েছে তার। আর! পুরোটা না হলেও সেই সফরের মাধ্যমে ভয় অনেকটাই কেটে গিয়েছিলো মোনালিসার। পরবর্তীতে লাদাখে এক স্থানীয় মাউন্টেনিয়ারি সংস্থায় পর্বতারহীদের গাইড হিসেবে কিছুদিন কাজ করার সুযোগও হয়েছিল তার।
শিলচর কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রী মোনালিসা উচ্চতর মাধ্যমিক পাশ করেছে সেন্ট ক্যাপেটেনিও স্কুল থেকে। স্নাতক স্তরের পড়াশুনা এখনও চলছে। তবে এই বয়সেই মোনালিসা অনেকটাই ম্যাচুয়েট। তার কথা অনুযায়ী, ‘ বাড়িতে বসে থেকে লাভ নেই। সবার উচিত নিজেকে এক্সপ্লর করা। পর্বতেরোহনের মত রোমাঞ্চে ভরা কার্যকলাপের মাধ্যমে যুব প্রজন্ম নিজেদের নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ পাবে। ট্রেকিং আপনাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেবে। প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে সাহায্য করবে। পরিচয় করিয়ে দেবে নতুন নতুন লোকদের সঙ্গে। তাই তো বলব,’ গো ফর ট্রেকিং ‘ । অন্যান্য কথার পাশাপাশি বাবা মিলন করকে নিজের জীবনের সত্যিকারের ‘ নায়ক ‘ আখ্যায়িত করলেন মোনালিসা। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য,’ উনার মত বাবা যেন সবাই পায়। আমি সত্যিকার অর্থে ভাগ্যবান। আমার প্রত্যেক সিদ্ধান্তকে সম্মান করেছেন তিনি। উনার চোখেই আমি আমার স্বপ্নগুলিকে দেখেছি। উনার মত বাবা যেন সবাই পায়। আরেকটা কথা বলব, সর্বদা ছেলেমেয়েদের সিদ্ধান্তের সম্মান করা উচিত। ‘
এবার আকাশকে ছুঁতে চায় মোনালিসা। কল্পনার খোলস ছেড়ে গা ভেজাতে চায় বাস্তবের ঝর্ণায়। প্রজাপতি হয়ে উড়ে গিয়ে স্পর্শ করতে চায় পৃথিবীর বুকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই মাউন্ট এভারেস্টকে। তবে শুধু বললেই তো হবে না। এই স্বপ্নপূরণে মানসিক, শারীরিক শক্তির পাশাপাশি চাই অর্থের বহরও। এভারেস্ট অভিযানে কম করেও ত্রিশ – বত্রিশ লক্ষ টাকা প্রয়োজন মোনালিসার। তাই শিলচর সহ গোটা উপত্যকার কাছে সাহায্যের আর্জি জানিয়েছেন মোনালিসা।
দা ভিঞ্চির পট্রেট ছেড়ে বাস্তবের বাগানে ফুল ফুটেছে। এই মোনালিসার ঠোঁটের ফাঁকেও ঝিলিক দিচ্ছে রহস্যময়ী সেই হাসি। আর তা বজায় থাকুক। এজন্য চাই সবার সহযোগিতা। ঠিক তাই না…..।