(গত সংখ্যার পর )
অনলাইন ডেস্ক : কাছাড়ে নিজেদের শাসনকালে ঠালিগ্রামে মা কালীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কোচ রাজারা । সেইসঙ্গে এই মন্দির এবং কাঁচাকান্তি মন্দিরে পুজো অর্চনার জন্য সিলেট থেকে নিয়ে এসেছিলেন কিছু ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের লোকজন, যারা গভীর ভক্তিভাবে পুজোর্চনার কাজ করতেন দুটি মন্দিরে।
পৌরাণিক কথা অনুযায়ী, নিজের রাজত্বকালে আচমকা একদিন স্বপ্নে মায়ের দর্শন করেছিলেন তৎকালীন কোচ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রধ্বজ নারায়ণ (১৭৭২-১৮১৩)। মা কাঁচাকান্তি তাঁকে মন্দিরে সোনার চার হাতের মূর্তি বানিয়ে সেই বিগ্রহের পুজোর নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে লোককথায় প্রকাশ। সেই আদেশ অনুযায়ী সোনায় মোড়া মা কাঁচাকান্তির ১৬ ইঞ্চির বিগ্রহের পুজো শুরু করেছিলেন কোচ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রধ্বজ নারায়ণ। ধর্মীয় রীতিনীতি মেনেই পুজোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন রাজ পুরোহিত সোনারাম শর্মা। কাঁচাকান্তি মন্দির নিয়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের শাসনকালেই এক ঘটনা ঘটে, যা ইতিহাসের পাতায় চিরদিনের জন্য লিপিবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে বেশ সখ্যতা ছিল জয়ন্তীয়া রাজার। বন্ধুর ডাকে একবার কাছাড়ে ভ্রমণে এসেছিলেন জয়ন্তীয়া রাজা। সেই ভ্রমণকালে কোনো এক ছুটির দিনে জয়ন্তীয়া রাজাকে কাঁচাকান্তি মন্দিরে নিয়ে যান রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। সেখানকার মায়ের স্বর্ণ মূর্তি দেখে জয়ন্তীয়ার রাজা এতটাই অভিভূত হন যে সেটাকে নিজ রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু সেই ইচ্ছে কিংবা প্রস্তাবকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেন রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র। সেই সময়টায় ভগ্ন হৃদয়ে নিজ রাজধানীতে ফিরে গেলেও কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন না জয়ন্তীয়ার রাজা। যে কোনো মূল্যে তাঁর মা কাঁচাকান্তির স্বর্ণ মূর্তিটা চাইই চাই। নিজের রাজ পুরোহিতের সঙ্গেও তিনি আলোচনা করেন, কিভাবে মূর্তিটাকে জয়ন্তীয়া পাহাড়ে নিয়ে আসা যায়। অবশেষে রাজার নির্দেশে ছদ্মবেশে জয়ন্তীয়া রাজ্যের দুজন ব্রাহ্মণ উধারবন্দ আসেন। তাঁরা গোপনে মন্দিরে প্রবেশ করে মায়ের পায়ে নিজেদের উৎসর্গ করেন। তাঁদের ভক্তিভাবে তুষ্ট হয়ে মা কাঁচাকান্তি স্বপ্নে তাদের দেখা দিয়ে বলেন, মূর্তি এখান থেকে জয়ন্তীয়া নিয়ে গেলে সে রাজ্যের কোনো ক্ষতি হবে না। নিজ ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে এই দৈব বার্তা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেন জয়ন্তীয়ার রাজা।
আর দেরি না করে মা কাঁচাকান্তির মূর্তি জয়ন্তীয়ার নিয়ে আসার জন্য নিজের বিশ্বস্ত সৈনিকদের উধারবন্দে পাঠান। যেমন কথা তেমনি কাজ। গোপনে তারা মূর্তি জয়ন্তীয়া নিয়ে যান। সেই রাতেই দেবী স্বপ্নে আসেন রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের রাজ পুরোহিতের। মা তাঁকে মূর্তি চুরির বিষয়ে অবগত করান। সঙ্গে এটাও বলেন, এখন থেকে তিনি জয়ন্তীয়া পাহাড়েই থাকবেন। কিন্তু উনার মুখটা সর্বদা হিড়িম্বা বংশের দিকেই থাকবে। সঙ্গে এই নির্দেশও দেন তারা যেন মূর্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা না করে। আগে যেভাবে ছিল সেভাবেই পুজো চালিয়ে গেলে হিড়িম্বা বংশের কেউই ক্ষতি করতে পারবে না।
চুরি পর্বের পর মূর্তির স্থানে অনেক বছর একটি খড়্গ রেখে সেটির পুজো করা হত। এভাবে প্রায় ৯০ বছর কেটে গিয়েছিল। তারপর কাঁচাকান্তি মন্দিরের এক পুরোহিত রামমানিক্য দেশমুখ্য মাটির প্রতিমা তৈরি করে আরাধনা শুরু করেন। এরপর মন্দিরের যেমন অনেক পরিবর্তন হয়েছে তেমনি মূর্তিও বদল হয়েছে। বর্তমান মূর্তিটা প্রয়াত কুলচন্দ্র দেবের তত্ত্বাবধানে তৈরি করেছেন শিলচরের প্রখ্যাত শিল্পী প্রয়াত অমর আচার্য।
( ক্রমশ )