বিচারপতিদের নিয়োগ নিয়ে সাম্প্রতিক কালে যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, গণতান্ত্রিক এ দেশে তা কোনওভাবেই সুখকর নয়। অথচ, ২০১৫ থেকে বিষয়টি নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হচ্ছে। উভয়পক্ষের কেউ এইটুকু জায়গাও ছাড়তে নারাজ। ফলে, আপাতদৃষ্টিতে দু’পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুযুধান বললে অত্যুক্তি হবে না। বিবাদের সূত্রপাত বিচারপতি নিয়োগে সরকার বা সংসদের হস্তক্ষেপ নিয়ে। সুপ্রিম কোর্টের সাফ কথা, বিচারপতি নিয়োগের চালু ব্যবস্থাই বহাল থাকবে। কিন্তু বর্তমান সরকার তা মানতে রাজি নয়। উল্টো আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু জানিয়েছেন, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের চলতি ব্যবস্থা অত্যন্ত অবাস্তব। তাছাড়া বিশ্বের কোনও দেশে এমন ব্যবস্থা নেই যেখানে বিচারপতিরা নিজেরাই নিজেদের নিয়োগ করেন।
আইনমন্ত্রীর মতে, বিচারপতি নিয়োগে চলতি পদ্ধতির পরিবর্তন না হলে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতির শূন্যপদ পূরণে সময় লাগবে। ইতিমধ্যে রাজ্যসভায় এ নিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্যে এ জানিয়েছেন যে, দেশের হাইকোর্টগুলিতে ৩০০-র বেশি অর্থাৎ ৩০ শতাংশ বিচারপতির পদ খালি পড়ে রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতির শূন্য পদের সংখ্যা ৭। এই পরিস্থিতিতে সারা দেশে বকেয়া মামলার পরিমান পাঁচ কোটির মতো। দিন কয়েক আগে সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় এবং সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ইউইউ ললিতের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে বিচারপতি নিয়োগের জন্য গঠিত জাতীয় বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশনের পক্ষে সওয়াল করেন । সংসদে তিনি এ সংক্রান্ত আইন পাশের পক্ষে তাঁর যুক্তি তুলে ধরেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পাশ হওয়া আইন বিচার বিভাগ খারিজ করেছে। তাঁর কথায়,বিশ্বের কোনও দেশেই বিচার বিভাগ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এভাবে চালু নয়।
এই পরিস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতির পদ মর্যাদার প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কোনও পাল্টা মন্তব্য না করলেও আইনমন্ত্রীর অভিমত খণ্ডন করে সাম্প্রতিককালে একাধিকবার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। শীর্ষ আদালত পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে, বিচারপতি নিয়োগের বর্তমান ব্যবস্থাই বহাল থাকবে। বিচারপতি নিয়োগের অধিকার কার হাতে থাকবে, এ নিয়ে সরকার ও বিচারা বিভাগের মধ্যে বিবাদ সাম্প্রতিককালে নয়া মাত্রা পায় জনৈক বিচারপতি কেন্দ্রকে নোটিশ ধরানোর জেরে। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারিতে কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘসূত্রিতা অবলম্বন করছে কেন, সে ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আইন সচিবকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ধরিয়ে দেন। কিন্তু আইনমন্ত্রী রিজিজু এ নিয়ে বিরূপ মন্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ অসন্তোষ প্রকাশ করে। এতে দেশের শীর্ষ আদালতের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
আসলে একাধিক মামলায় সুপ্রিম কোর্টের অধিকার নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য নোটবন্দির বিরুদ্ধে উত্থাপিত মামলা। কেন্দ্রের দাবি, বিষয়টি সরকারের নীতিগত বলে আদালতের নাক গলানো উচিত নয়। একইভাবে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্তির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েও আদালতের হস্তক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সরকার। প্রসঙ্গত, বিচারপতি নিয়োগে ১৯৯৩ সালে চালু হওয়া কলেজিয়াম ব্যবস্থায়
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সিনিয়র বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত কমিটিই হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করে। তাঁদের বদলির সিদ্ধান্তও এই কমিটির হাতে। কিন্তু ২০১৫ সালে এই ব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে আনতে বিচারপতিদের নিয়োগের একটি কমিশন গঠন করে কেন্দ্র। সুপ্রিম কোর্টের আপত্তিতে সেই কমিশন দিনের আলো দেখেনি। নিয়োগ ও বদলিকে সরকাররে নাক গলাতে দিতে নারাজ সুপ্রিম কোর্ট। এই পরিস্থিতিতে সরকার ও শীর্ষ আদালতের এই টানা হ্যাচড়ার অবসান যত শীঘ্র হয়, ততই মঙ্গল।