হিমু লস্কর
আনাজের বাজারে একে অগ্নিমূল্য, তার ওপর কবেই কোয়াড্রপল সেঞ্চুরি পার করেছে কাঁচা লঙ্কা। সবমিলিয়ে ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ শিলচরের বাজারেও মঞ্চস্থ হয়েছে আরেকপ্রস্থ ‘লঙ্কাকাণ্ড’! তফাত শুধু এটাই যে, এই লঙ্কাকাণ্ডে রাবণের স্বর্ণপুরীর বদলে হাত পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের। আর কুম্ভকর্ণের মতো গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে প্রশাসন।
ফি বছর বর্ষা মরসুমে বাজারে আনাজপাতির দাম বাড়ে। পকেট কাটা যায় উৎসবের মরসুমেও। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে আওয়াজ উঠলেও জীবনের দৈনন্দিন যাঁতাকলে একসময় তা স্তিমিত হয়ে আসে। ইচ্ছে-অনিচ্ছের দোলাচলে একে নিয়তি ভেবেই মানিয়ে চলার চেষ্টা করেন সবাই। তবে এবার যেন অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এক নয়া নজির গড়েছে শিলচর। ফাটক বাজার, ন্যাশনাল হাইওয়ে পয়েন্ট বাজার, কলেজ রোড মিউনিসিপ্যাল মার্কেট, সঞ্জয় মার্কেট, ইটখলা বাজার সহ শহর এবং শহরতলীর প্রায় সব-কটি বাজারে যেন লেগেছে আগুন। খুচরো বাজারে কাঁচা লঙ্কা বিকোচ্ছে প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা দরে ! ১ কেজি আদার দাম ৩০০টাকা শুনে দস্তুরমত ভিরমি খাবার জোগাড়।
সেঞ্চুরি হাঁকানোর পর মধ্যবিত্তের পাত থেকে কবেই বিদায় নিয়েছে টমেটো। এবার একই পথে হাঁটছে শশা ও বেগুন। শিলচরের বেশ কয়েকটি বাজারে টমেটো বিকোচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা দরে। শতকের ঘরে ঘোরাফেরা করছে বেগুনের দাম। লাউ, উচ্ছে, ঢ্যাঁড়স, ডাঁটা, পুই সহ অন্যান্য শাকসবজিও মহার্ঘ। এরমধ্যে কাঁচা লঙ্কার দামে যেন চোখে শর্ষে ফুল দেখছেন মধ্যবিত্তরা।
শিলচরের বাজারে কাঁচা লঙ্কার এমন দাম শেষ কবে দেখেছেন, মনে করতে পারছেন না প্রবীণেরাও। অথচ মাস খানেক আগেও মরিচের দাম ছিল ৬০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে। তাহলে এমন কী ঘটল যে মাত্র এক দেড়মাসে মরিচের দাম বেড়ে ৪০০ টাকা হয়ে গেল?
শিলচরের বিভিন্ন বাজারে কয়েকজন আনাজ ব্যবসায়ীর কাছে এর কারণ জানতে চাইলে একেকজন একেক যুক্তি দর্শিয়েছেন। এক জন বলেছেন, টানা খরার পর হঠাৎ অতিবৃষ্টিতে নাকি বেশির ভাগ মরিচগাছ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে কারণে অধিকাংশ গাছে ফলন নেই বললেই চলে। এর ওপর টানা বৃষ্টিতে মরিচ সংগ্রহের কাজটি কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে মরিচের দাম বেড়েছে। আরেক ব্যবসায়ীর যুক্তি, শিলং রোড বন্ধ থাকার কারণেই নাকি মরিচের মূল্যবৃদ্ধি ! কিন্তু এখন তো শিলং রোড সচল, তবে? না, কোনও উত্তর দেননি ওই ব্যবসায়ী ! বললেন, সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে মরিচের। আমরা বেশি দামে কিনছি, কমে তো বেচতে পারি না।
ঘটনা হচ্ছে, কাঁচা লঙ্কার দাম শুধু এই উপত্যকায় -ই নয়, বেড়েছে সর্বত্র। মরিচের ঝাঁজে পুড়ছে বাংলাদেশ-ও। জানা গিয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশে মরিচ রফতানি করেছে ভারত। আনাজের বাজারে লাগাম টানতে পশ্চিমবঙ্গে টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে সরকার। কিন্তু বরাক উপত্যকায় এখন পর্যন্ত এমন কোনও পদক্ষেপ নজরে পড়ছে না। এ নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বিভিন্ন ক্রেতা। তাঁদের অভিযোগ, আনাজ ব্যবসায়ীদের উপর প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নেই। যেকারণে, প্রতিটি উৎসবের মরশুমে লাগামহীন হয়ে পড়ে দ্রব্যমূল্য। এবারও সর্বত্র নিত্যপণ্য সহ আনাজপাতির দাম আকাশছোঁয়া। নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের। কিন্তু সরকার ও প্রশাসন যেন কুম্ভনিদ্রায়। গ্রাহকেরা বলছেন, শিলচরের ফাটক বাজার নিউ মার্কেট-ই হোক কিংবা অন্যকোনও বাজার— সবখানেই সবজির দাম আকাশ ছোঁয়া। অনেকের অভিযোগ পাইকারী মূল্যের দ্বিগুণ দামে আনাজপাতি বিকোচ্ছে খুচরো বাজারে। তাঁদের প্রশ্ন, বাজারের উপরের সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই কেন? প্রশাসনও কী চোখ বন্ধ করে আছে?
তথ্য বলছে, গণ-বণ্টণ বিভাগের অধীনে নেই সবজি বাজার। কৃষি বিভাগেরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এতে পোয়াবারো হয়েছে সিন্ডিকেটের। ফুলকপি, বাঁধাকপি, পটল, টমেটো, কাকরুল, মিষ্টি কুমড়ো ইত্যাদি সবজির বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছেন সিন্ডিকেট। আকাশ ছুঁয়েছে কাঁচালঙ্কা। বাজারে খারুপেটিয়া, শিলং ও ত্রিপুরা থেকে সবজি আসছে। স্থানীয় স্তরে পরিকল্পনা মাফিক সবজির মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন ভুক্তভোগীরা। এমন পরিস্থিতিতে সরকার প্রদত্ত পাইকারি ও খুচরা মূল্যের তালিকা জনসমক্ষে আসা উচিত বলে মনে করছেন জনগন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব নিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানিয়েছেন সবাই।