অনলাইন ডেস্ক : বড় দেশ, তাই বড় বড় বিলাপ। কি ছাইপাশ, এই ব্রিজভূষণ শরণ সিং লোকটা। চল্লিশটির উপর মামলা। সেইসঙ্গে সংযোজিত দেশের শীর্ষাস্থানীয় মহিলা কুস্তিগীরদের উপর যৌননির্যাতনের ইস্যু। যন্তরমন্তরে আধোপেট খেয়ে রাতদিন এক করেও কিছু অদৃশ্য শক্তির (!) বদান্যতায় আজও ‘স্পেশাল কেস ‘ স্ট্যাটাসটা পাচ্ছে না ভিনেশ, সাক্ষীদের কাকুতি -মিনতি। সার্জিকাল স্ট্রাইক, নোটবন্দি, অভিমুন্যর এয়ার স্ট্রাইক কিংবা এনকাউন্টার নিয়ে বরাবর বাহবা কুড়ানো প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, যোগীরা একটা শব্দও খরচ করছেন না। ‘ সত্যিই আজব এই দেশ’ সেলুকাসের উক্তিটা বোধহয় চিরদিনের জন্য অমর হয়ে থেকে যাবে। শুধুমাত্র সংযোজন হবে আজব এই দেশের ন্যায়।
মোদ্দা কথা হল প্রভাবশালীদের উপর সমর্থন থাকার বিষয়টা নতুন কিছু নয়। সমানে চলেছে সেই ‘ট্র্যাডিশন’— ক্ষমতাধরের অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে পুলিশ-প্রশাসনের হাত গুটিয়ে থাকা, অযথা দেরি করা, অজুহাত দেওয়ার রীতি।
ব্রিজভূষণ ক্রীড়াক্ষেত্রে বাহুবলি হিসেবে উঠে এসেছেন। নিজের মর্জিমাফিক কুস্তি সংস্থার নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে, ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্রিজটা বেশ দীর্ঘ। তবে মারাত্মক অভিযোগটি মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থা ও ভয় দেখানোর। এই যৌন হেনস্থা ও হুমকি দেওয়া চলছে গত দশ বছর ধরে, কখনও ব্রিজভূষণের বাংলোয়, এমনকি ভারতে ও বিদেশে কুস্তি প্রতিযোগিতা চলাকালীনও— পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন সাত মহিলা কুস্তিগির, তাঁদের অন্যতম এক নাবালিকাও!
হয়েছে দু’টি এফআইআর, তার মধ্যে একটি ‘পকসো’ ধারা মেনে।
দেশের শাসন ব্যবস্থার এমনই দুরবস্থা, অভিযোগকারী আদালত পর্যন্ত না পৌঁছলে, বিচারকের নির্দেশটি কড়া তিরস্কার সমেত না এলে এই জমানায় কুটোটি নড়ে না, বার বার প্রমাণিত।
মূল বিষয়টা হল শাসকদলের এক শক্তিশালী মুখ ব্রিজভূষণ। ব্রিজভূষণ উত্তরপ্রদেশের ছ’বারের সাংসদ, বিজেপির হয়ে নানা আসনে পাঁচ বার জয়ী। রাম জন্মভূমি আন্দোলন ও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলা, দু’টিতেই তাঁর নাম জড়িয়ে। এই মানুষটিই জাতীয় কুস্তি সংস্থার তিন বারের প্রেসিডেন্ট, ভারতে কুস্তি ও কুস্তিগিরদের নিয়ে যে কোনও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাঁর কথাই শেষ কথা। কিন্তু দিল্লির কর্তব্যক্তিদের ভিনেশ, সাক্ষী, বজরংদের কথাও ভুললে চলবে না। কুস্তিতে দেশকে অনেক গৌরবের মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন ভিনেশ ফোগাট, সাক্ষী মালিক এবং বজরং পুনিয়ারা। কিন্তু এই অলিম্পিয়ানরাই এখন দেশের রাজধানীর ফুটপাতে !! বিষয়টা ভারতীয় ক্রীড়াঙ্গনের জন্য চরম লজ্জার। বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও – স্লোগানের দেশে বেটিদের রাত কাটছে রাস্তার ধারে। সরকার চাইলে সাক্ষীদের ফুটপাতে থাকতে হতো না। একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্রিজ ভূষণকে কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারত। কিন্তু এমনটা হয়নি। কেন্দ্র সরকার তখন ব্যস্ত ছিল মন কি বাত ও আসন্ন কর্ণাটক নির্বাচন নিয়ে। কেউ মুখে তেমন একটা রা কাড়েননি, তেমনি মিডিয়ার আলো থেকেও বিষয়টা দূরে ছিল। সেটা হল –
৬ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তথা অলিম্পিক পদকজয়ী এমসি মেরি কম, অলিম্পিক পদকজয়ী যোগেশ্বর দত্ত এবং দোলা ব্যানার্জি সম্মলিত তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিল বিষয়টা তদন্তের জন্য। সেই কমিটি কথা বলেছিলো ভিনেশদের সঙ্গে।এই কমিটির সামনে নিজেদের অভিযোগ তুলে ধরেন তারা । কিন্তু তাদের কথাতেও অসংগতি ছিল। প্রথমে ভিনেশরা অভিযোগ করেন ব্রিজ ভূষণ হরিয়ানার অনেক মহিলা কুস্তিগীরকে যৌন নির্যাতন করেছেন। তাদের নামও কমিটির সামনে পেশ করেন। তবে সেই তালিকায় থাকা একজনও কমিটির সামনে ভিনেশদের মন্তব্যকে সমর্থন করেননি। এরপর ভিনেশ অভিযোগ করেন, তাকেও ২০১৬ সালে যৌন নিগ্রহ করেছিলেন ব্রিজ ভূষণ। কিন্তু যে ঘটনার কথা ভিনেশ তদন্ত কমিটির সামনে উল্লেখ করেন, যৌননির্যাতন নিয়ে পরিষ্কার ইভিডেন্স তুলে ধরতে পারেননি ভিনেশরা। সমর্থন না পাওয়ায় তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে সরকারের কথাতেই কাজ করার অভিযোগ তুলেন তারা। এর অর্থ হচ্ছে এমসি মেরি কম, যোগেশ্বর দত্ত মিথ্যা কথা বলছেন? প্রশ্নটা কিন্তু বেশ গুরুতর। মেরি কম দেশের অন্যতম রোল মডেল। তাকে এভাবে অপমান করা হলো, মিথ্যাবাদী বলা হলো, অথচ এ নিয়ে কোন টু শব্দ নেই!!
ভারতীয় ক্রীড়াঙ্গনে ভিনেশ ও সাক্ষী মালিক থেকে মেরি কম ও যোগেশ্বর এর অবদান অনেক বেশি। তদন্ত কমিটির কাছে হাজির হবার দিনই রাজধানীতে ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার দাবি নিয়ে অনশনে বসেন সাক্ষী ভিনেশরা। অনেকটা দেরিতে হলেও সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে এফআইআর নিতে বাধ্য হয় দিল্লি পুলিশ।
ক্রীড়াক্ষেত্রেও বিষয়টা নিয়ে মতান্তর রয়েছে। বিরাট, অভিনব বিন্দ্রারা পাশে দাঁড়ালেও পি টি ঊষার মত চ্যাম্পিয়ন এথলিট বিষয়টার জন্য দেশের খেলাধুলার মাথা হেট্ হচ্ছে বলে তীব্র ভাষায় সাক্ষীদের কটাক্ষ করেন। রাজনীতির ‘ময়লা ‘ ক্যানভাসে বিষয়টা নিয়ে তুলিতে শান দিচ্ছেন রাজনীতির কুশীলবরা। বিবৃতি পাল্টা বিবৃতিতে আখড়ায় দঙ্গলটা বেশ ভালোয় জমে উঠেছে। রাহুল, প্রিয়াঙ্কা, কেজরিওয়ালরা তো রয়েছেনই। বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় জেল খাটা পাপ্পু যাদবও ভিনেশদের মঞ্চে বসে সেলফি শেয়ার করছেন। আর খাপ পঞ্চায়েত! মেয়েরা ‘এ ‘ বলার পরিবর্তে ‘বি ‘ বলে দিলে যারা শাস্তির নিদান দিয়ে বসে এই পঞ্চায়েতের পাগড়িওয়ালারা ‘মারো ছোড়ি’ সম্বোধন করে ভিনেশদের জন্য যুদ্ধের ইয়ালগার দিচ্ছে। এসবই রাজনীতি গুরু, রাজনীতি।
বিরোধীরা তো সুযোগ নেবে এটাই স্বাভাবিক। আগে স্মৃতি ইরানি গলায় আলু পেঁয়াজের মালা নিয়ে এখন প্রিয়াঙ্কারা করছেন। সময় পাল্টেছে, সরকারের রং পাল্টেছে, বিরোধীদের বিরোধিতার রং পাল্টায়নি। সরকার অল্প পজিটিভ মুভ নিলে এত সমস্যার সৃষ্টি হতো না।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনও পদক্ষেপের কথা শোনা যায়নি প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী-সহ কারও কাছ থেকেই। বিশ্ব স্তরে পদক জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী যাঁদের ‘নিজের মেয়ে’ বলে বাড়ি ডেকে সম্মান জানিয়েছিলেন, তাঁরাই আজ দিল্লির রাস্তায় প্রতিবাদরত, এবং উপেক্ষিত। ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থার প্রতিবাদ নতুন নয়, গত জানুয়ারিতে তাঁদের প্রতিবাদের জেরে সরকার কমিটি তৈরি করে চার সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলেছিল, সেই রিপোর্ট জমা পড়েছে এপ্রিলে। তাতেও কোনও ‘কাজ’ হয়নি, প্রভাবশালীর প্রভাব খর্ব হয়নি, এত কিছুর পরেও জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা হয়েছে ব্রিজভূষণের এলাকা গোন্ডা-তে। ক্ষমতার রাজনীতির ছায়াটি দীর্ঘ, তার সঙ্গে কুস্তি করতে গেলে গাত্রে যে ব্যথা হতে বাধ্য, আন্দোলনকারী কুস্তিগিররা বিলক্ষণ বুঝছেন।
রাজনীতি – অরাজনীতি যাই হোক। আদতে ক্ষতিটা কিন্তু হচ্ছে খেলাধুলারই। মাথা হেট্ হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। ফলে চাই একটা পজিটিভ মুভ। যাতে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়।