কুন্তল চক্রবর্তী
অগ্নিমূল্যের বাজারে নিত্যদিন পা মাড়াতে হয় যাঁদের, সেই গৃহস্থেরা জানেন, হেঁসেলে একটু আনাজপাতি ঢোকাতে গিয়ে নাজেহাল হওয়া কাকে বলে। বেশিরভাগ আনাজের দামই হয় সেঞ্চুরির আশেপাশে নয়তো দ্রুত সেদিকেই এগোচ্ছে। কাঁচালঙ্কার কেজি পিছু দর আবার ডাবল সেঞ্চুরির ঘাড়ের কাছেই নিশ্বাস ফেলছে। মুল্যবৃদ্বির ফলে বাস্তবিকই মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। আগুনে বাজারের ছেঁকায় আমজনতা যখন জেরবার, সেই সময় শাসক দলের নেতাদের শস্তা বয়ান গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। খাদ্য ও অসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী রণজিৎ কুমার দাস বলছেন, শাক-সব্জির দামের সঙ্গে তাঁর বিভাগের কোনও সম্পর্ক নেই। পরক্ষণেই তাঁর মন্তব্য, দেশের অন্যান্য শহরের চাইতে গুয়াহাটিতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম কম। এ-ও মনে করেন তিনি, উন্নত দেশে মূল্যবৃদ্ধি স্বাভাবিক ব্যাপার। আর চালের দাম নিয়ে তাঁর অমৃতবাণী, পাকিস্তানের তুলনায় এখানে চালের দর তো কম। যা শুনে এক মধ্যবিত্তের টিপ্পনি, যাক, পাকিস্তানিদের থেকে তো সস্তায় চাল খাচ্ছি, এই আমাদের আচ্ছে দিন! কংগ্রেস জমানায় মূল্যবৃদ্ধির সরব প্রতিবাদে রীতিমতো বিপ্লবের ডাক দেওয়া ডিব্রুগড়ের বিধায়ক প্রশান্ত ফুকন আজকাল আর অগ্নিমূল্যের বাজার দেখতে পান না। গলায় পেঁয়াজের মালা ঝুলিয়ে আর গরুর গাড়িতে চড়ে তাঁকে অভিনব প্রতিবাদ করতে দেখেছেন রাজ্যবাসী। রাজনীতি বড় বালাই। আজ শাসক দলের বিধায়ক, তাই মুখে খিল দিয়েছেন প্রশান্ত। কিন্তু তাতে তো আর নিম্ন মধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্তের সমস্যা একবিন্দুও কমে না।
বাজারে ঢুঁ মারলে আনাজের ছড়াছড়ি। কিন্তু যাতেই হাত দিন না কেন ক্রেতারা, দামের আগুনে পুড়বেই। একবার একটু খোলা বাজারের ছবিটা দেখা যাক। ঢেঁড়স ৭০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। কোয়াশের দামও ৭০-৮০ টাকা। পেঁপে ৬০-৭০ টাকা। মিষ্টি কুমড়ো ৬০ টাকা। ঝিঙে ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিকোচ্ছে। পটলের দাম ৮০ থেকে ৯০ টাকা। বেগুন ৭০-৮০ টাকা। উচ্ছে ৮০ টাকা। কাঁকরোল ৭০ থেকে ৮০ টাকা (খুচরো বাজারের খতিয়ান। সব দাম কেজি-র হিসেবে)। সেদিন এক ক্রেতা কিছুটা মজা করেই বলছিলেন, নাগরিক ক্লান্তিতে তোমাকে চাই বলে যে বিট নুন মাখানো শসায় কামড় বসাবো তারও কি জো আছে। শশার কেজি পিছু দাম তো সেঞ্চুরি ছুঁইছুঁই করছে। আর কাঁচালঙ্কা?এই মুহূর্তে ২৪০ টাকা কেজি। ছুঁলেই দামের আগুনে হাত জ্বলছে। প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা চিত্ত পাল বলছিলেন, দশ কেজি-র বৃন্দাবন চালের ব্যাগের দাম গত কয়েকমাসে দেড়শো টাকা বেড়েছে। মানুষ খাবে কি? রাজ্য বিজেপি সভাপতি ভবেশ কলিতা সম্প্রতি বলেছেন, জনসংখ্যা বেড়েছে, মানুষ খাচ্ছে বেশি। অতএব দাম তো বাড়বেই । লেখক তুষারকান্তি সাহা এই মন্তব্যের পাল্টা জবাবে ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে নচিকেতার গানের কলি ধার করে বললেন, ‘তবু রেডিওটা টিভি-টার সাথে সুর ধরে, সারে জাঁহা সে আচ্ছা।’
প্রশ্ন হলো, মানুষকে একটু স্বস্তি দিয়ে মূল্যবৃদ্ধির লাগাম কি টেনে ধরা যাবে? আপাতত তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেননা কৃষিবিদরা বলছেন, সদ্য প্রথম দফার বন্যা হয়ে গেল প্রায় গোটা রাজ্যকে ভাসিয়ে। তাই এই মুহূর্তে নতুন ফলন হবে না। কিন্তু খারুপেটিয়ার কৃষকরা বলছেন, গুয়াহাটি কিংবা রাজ্যের অন্যত্র আনাজের দাম জেনে তাঁরা অবাক। এই কৃষকরা কিন্তু তাঁদের উৎপাদিত সামগ্রীর এত দাম পাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেন না। তাহলে খোলা বাজারগুলোতে কেন মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ বেড়েই চলেছে তার একটাই উত্তর, রাজ্যজুড়ে ফড়েদের দাপাদাপি। এরাই বাজারের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। ক্রেতা মহলও মনে করছেন, এই ফড়েদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই বাজারের আগুন নিভবে।